৫০ হাজার টাকা পুঁজিতে শুরু করে ১০ টি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু। তাও আবার ব্যাংক ঋণ। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সাফল্য এসে লুটিয়ে পড়েছে তার কাছে। কর্মনিষ্ঠা, মেধা, সততা আর অদম্য পরিশ্রম দিয়ে একে একে গড়ে তোলেন ১০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১০ হাজার লোকের রুটি-রুজির সংস্থান এসব প্রতিষ্ঠানে। অবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতি ও সমাজ উন্নয়নেও।

ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন শতাধিক অ্যাওয়ার্ড। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান মীর গ্রুপ অব কোম্পানির কর্ণধার মীর নাসির হোসেন। বাবা মীর আকেব হোসেন এবং চাচা মীর আকতার হোসেনও ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু স্বাধীনতা পূর্বাপর কাকতালীয়ভাবে একইসঙ্গে ঘটে দুটি দুর্ঘটনা। ১৯৭৯ সালে মারা যান বাবা আকেব হোসেন।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের কাছে বাবার ব্যবসার মোটা অংকের টাকা আটকে যায়। স্বাধীনতার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়- পাকিস্তান সরকারের কোন দায়-দেনা বাংলাদেশের নতুন সরকার নেবে না। বিপদে পড়ে যান বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ভাই মীর নাসির হোসেন ও মীর জহির হোসেন। এরপর জনতা ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাবার পুরনো ব্যবসা শুরু করেন তারা। এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়া।

বর্তমানে বাংলাদেশে পারিবারিকভাবে গড়ে ওঠা ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মীর গ্রুপ। তিন প্রজন্ম ধরে ব্যবসা করে আসছেন মীর গ্রুপের উদ্যোক্তারা। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন মীর নাসিরের দুই সন্তান ছেলে রুসনান নাসির এবং মেয়ে মাহিরন নাসির। নতুন প্রজন্ম যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনি মীর গ্রুপের ব্যবসায়ও যোগ হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সব ব্যবসা। মীর গ্রুপের উত্থান-পতন, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রসার কিভাবে ঘটিয়েছেন সেই রোমাঞ্চকর গল্প শুনিয়েছেন মীর নাসির নিজেই।

মীর নাসির বলেন, আমাদের আদি বাড়ি হচ্ছে মাগুরা জেলার পুকুরিয়া গ্রামে। আমার দাদা তালুকদার ছিলেন। পুকুরিয়ায় তার তালুকদারি ছিল। সে সময় খাজনা আদায়ের জন্য বার্ষিক পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো। এই অনুষ্ঠানে এসে প্রজারা খাজনা পরিশোধ করতো। সে সময় তো লোকজন বিভিন্ন পন্থায় খাজনা দিতো। তখন তো টাকা-পয়সার চল কম ছিল। সোনার মোহর ছিল তখন।

চল্লিশের দশকে আমার বাবা মীর আকেব হোসেন কলকাতায় চলে যান। সঙ্গে আমার চাচা মীর আকতার হোসেনও। তখন তাদের ছাত্রজীবন। আমার দাদির কাছে তখন এরকম একটি মোহর ছিল। বাবা এবং চাচা যখন কলকাতায় যাচ্ছিলেন তখন আমার দাদি বললেন- ‘বাবা, তোমরা কলকাতায় যাচ্ছো, ওখানে তো আমরা থাকব না, দরকার হলে এই মোহরটা খরচ করবে।’ মাতৃস্নেহে তিনি মোহরটা দিলেন তাদের। তখন আমাদের পরিবারের আয় ছিল মূলত তালুকের আয় এবং কৃষিজ জমি থেকে পাওয়া আয়।

বাবা এবং চাচা যখন কলকাতায় তখন তাদের জন্য এখান থেকে টাকা পাঠাতে হতো। কিন্তু টাকা পাঠাতে মাঝেমধ্যে গ্যাপ পড়ে যেত। তখন তো টাকা পাঠানোর জন্য আজকের মতো এত আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না। কেউ কলকাতায় গেলে তার কাছে টাকা দিয়ে দেয়া হতো, সে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছে দিতো টাকা। তো বাবা এবং চাচা সোনার মোহরটা খরচ না করে দুজনে মিলে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করলেন। কি করা যায়? সিদ্ধান্ত নিলেন টানা-রিকশায় বিনিয়োগ করবেন এই মোহর। কয়েকটা টানা রিকশা কেনা হলো।

ধীরে ধীরে রিকশার সংখ্যা বাড়তে থাকলো। এক সময় অনেক রিকশা হয়ে গেল। এভাবেই বাবা এবং চাচার ব্যবসা শুরু হয়েছিল। এই ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। তারপর তারা কলকাতা সিটি করপোরেশনের লিজের ব্যবসা শুরু করলেন। সেই সঙ্গে প্যাকিংয়ের ব্যবসাও শুরু করলেন। বন্দর থেকে অকশনে কেরোসিন কাঠ কিনে নিয়ে আসতেন, ওই কাঠ দিয়ে বাক্স বানিয়ে সেগুলো সরবরাহ করতেন বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতায় তখন আয় মোটামুটি ভালোই চলছিল। মোটামুটি একটা বর্ধিষ্ণু পরিবেশ।

এরপর তো রায়ট শুরু হলো। আমাদের পরিবার যেখানে থাকতেন সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা কম ছিল। বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। আমার মায়ের মামা তখন কলকাতায় চাকরি করতেন। বাবা তখন মা এবং আমার ভাইবোনদের নিয়ে তার বাসায় উঠলেন। তারপর চিন্তা করলেন যে, এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। তাই আমার মা এবং বোনদের তিনি পুকুরিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। তারপর তো ’৪৭ সালে পার্টিশান হয়ে গেল। আমার বাবা এবং চাচাও কলকাতা থেকে ফিরে এলেন এখানে।

শৈশবের স্মৃতিচারণ করে মীর নাসির বলেন, মাগুরায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে তখন স্কুল-কলেজ তেমন একটা ছিল না। আমার মা খুব দূরদর্শী ছিলেন। তিনি মনে করলেন যে, গ্রামে থেকে ছেলেমেয়েদের ভালো পড়ালেখা করানো যাবে না। আমার নানা তখন ফরিদপুর জেলা পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার। আব্বার সঙ্গে পরামর্শ করে মা সবাইকে নিয়ে ফরিদপুর চলে এলেন। এটা ’৪৭-এর ঘটনা। আমার জন্ম ১৯৫১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর শহরে। আমরা দুই ভাই ও পাঁচ বোন। আমি ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় আর ভাইবোনদের মধ্যে পঞ্চম।

ফরিদপুরেই আমি পড়ালেখা শুরু করি। আমাদের পাড়ায় একটা স্কুল ছিল। সেটা এখন হাইস্কুল হয়েছে। তখন সেটা প্রাইমারি স্কুল ছিল। চিতৈশি স্কুল। আমি এই স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়ি। তখন জেলা স্কুলে ভর্তি হওয়া যেত ক্লাস ফোরে। জেলা স্কুলে ভর্তি হলাম ক্লাস ফোরে। এটা ১৯৫৮ সালের কথা। ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকেই আমি এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। পাস করে রাজেন্দ্র কলেজে কমার্সে ভর্তি হলাম। এই কলেজ থেকেই এইচএসসি পাস করি। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। দু’বছর পরই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ’৬৯-এর গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিই। ’৬৯-এর ৩রা জুলাই আমার বাবা মারা যান। তারপর আমি বাইরের জগতের সঙ্গে তেমন সংযুক্ত হইনি। আমার বাবা তখন ফরিদপুরে খুব প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। আমার বড় ভাই তখন ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিচ্ছে, আমি সেকেন্ড ইয়ারে। বাবা মারা যাওয়ায় আমাদের খুব অসুবিধা হয়ে গেল। সাংসারিকভাবেও আমরা সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলাম।

বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই ব্যবসায়ী নেতা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মীর নাসির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ফরিদপুরে। আমি ছাত্র জীবনে স্কাউটে ছিলাম, আমাদের কিছু বেসিক ট্রেনিং ছিল। সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ফরিদপুরে গিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে শুরু করি।

থ্রি নট থ্রি সহ কিছু রাইফেল আমরা জোগাড় করেছিলাম। প্রায় দুইশ’ ছেলে নিয়ে আমি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করি। কিন্তু এরপর যশোর থেকে আর্মি আসার পর সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমি মাগুরায় গ্রামের বাড়ি চলে যাই। আমি মোটামুটি সংগঠক হিসেবেই কাজ করেছি মুক্তিযুদ্ধে। যাই হোক, ’৭২ সালে আমি অনার্স পরীক্ষা দিলাম। সেশনজট হওয়াতে এত দেরি হয়েছে। এমকম কমপ্লিট হলো ’৭৪ সালে।

নিজের ব্যবসা শুরুর গল্প সম্পর্কে মীর নাসির বলেন, এমকম পাস করে আমি ফরিদপুর চলে গেলাম আবার। আমার বড় ভাই মীর জাহির হোসেন তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বাবার ব্যবসার হাল ধরেছেন। মীর আকতার হোসেন লিমিটেড, কনস্ট্রাকশন ব্যবসা। আমার চাচাত ভাইরা পরে এই ব্যবসায় কনটিনিউ করেনি। স্বাধীনতার পর আমাদের অনেক টাকা পাকিস্তান সরকারের কাছে আটকে গেল।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিলো, ২৫শে মার্চের আগে পাকিস্তানের যত দায়দায়িত্ব আছে তার দায় বাংলাদেশ সরকার নেবে না। আমাদের পাওনাটা ছিল পাকিস্তান সরকারের কাছে। ফলে এই টাকাগুলো আর পাওয়া গেল না। তাতে অর্থনৈতিকভাবে আমরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। তখন আমি ও আমার বড় ভাই নতুন করে ব্যবসা শুরু করলাম। কিছুই জানি না, বাবার গুডউইল আছে, তার খুব সুনাম আছে। এটাকেই কাজে লাগালাম। আমার চাচা মারা গেছেন বাবার আগেই। বাবা নিজের ফার্মের নাম রাখলেন ভাইয়ের নামে।

যাই হোক, আমরা দুই ভাই ব্যবসায় নেমে ধীরে ধীরে এগুতে থাকলাম। ফরিদপুরে আমি ’৭৪ থেকে ’৮২ পর্যন্ত ছিলাম। তারপর ভাবলাম যে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করা দরকার। বড় ভাই তখন ঢাকায় কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা করছেন, আর আমি ফরিদপুরে। ভাবলাম যে দুজনে মিলে চেষ্টা করলে ভালো করতে পারব। তাছাড়া আমার মা বললেন, আমি ফরিদপুরে থাকবো আর বড় ভাই ঢাকায় থাকবে- এতে দুই ভাইয়ের মধ্যে জেনারেশন গ্যাপ হয়ে যেতে পারে।

তাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা, লাইফ স্টাইল ইত্যাদি হয়ত অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হবে। এই অসামঞ্জস্য যাতে না হয় তাই আমার মা আমাকে উৎসাহিত করলেন ঢাকা চলে আসতে। মা ভাবলেন, দুই ভাইয়ের মধ্যে সবদিক থেকে সামঞ্জস্য থাকা দরকার। আমার মা খুবই বিচক্ষণ নারী ছিলেন, ধার্মিক ছিলেন। তিনি আমাকে ঢাকায় আসতে উৎসাহ দিলেন। এবং আমাদের যে কাজের লোকটা ছিল, যে রান্নাবাড়া করতো, তাকেও আমার সঙ্গে দিয়ে দিলেন।

তিনি ঢাকায় এসে আমাকে স্যাটেল হতে সাহায্য করলেন। আমি মনে করি, আমার মায়ের সেই ডিসিশনটা ছিল শতভাগ সঠিক। তবে ফরিদপুরের সঙ্গে আমার বন্ধন রয়ে গেল। ফরিদপুরে ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত, ফরিদপুরের সামাজিক জীবনের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত। ১৯৮৪ সাল থেকে ফরিদপুর চেম্বারের আট বার আমি সভাপতি নির্বাচিত হই। ঢাকায় থেকেও আমি ফরিদপুর মেনটেইন করতাম। ফরিদপুরের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতাম।

ব্যবসার প্রসারের জন্য একসময় ফরিদপুর থেকে ঢাকায় চলে আসেন মীর নাসির। সে ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার ভাই তো ঢাকায় কনস্ট্রাকশন ব্যবসা করছে তখন। ঢাকা আমাদের হেড অফিস। আমি এসে হেড অফিসে জয়েন করলাম। দুই ভাই একসঙ্গে কাজ শুরু করলাম। তখন বিভিন্ন জায়গায় কাজ নেয়া হতো। তিনি কোনটায় যেতেন, কোনটায় আমি যেতাম। ঢাকার বাইরের কাজগুলো আমি দেখতাম আর তিনি ঢাকার কাজগুলো দেখতেন। টেন্ডার প্রিপারেশন থেকে শুরু করে সবকিছু তিনি দেখতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ একজন ইঞ্জিনিয়ার।

একটা সময় আমরা চিন্তা করলাম যে কনস্ট্রাকশনের মধ্যে ব্যবসা সীমাবদ্ধ থাকলে ভবিষ্যতে বেশিদূর এগুনো যাবে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আসছে। তাদের মধ্যে জেনারেশন গ্যাপও হতে পারে। তাই আমরা কিছু প্রতিষ্ঠান ডাইভার্ট করে দিলাম। মীর আক্তার হোসেন লিমিটেড দুই পরিবারের মালিকানাধীন থাকলো, অন্যগুলো ভাগ করে দেয়া হলো।

আমরা মনে করলাম যে, হয়তো আমরা দুই ভাই একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে এভাবে যৌথভাবে নাও করা যেতে পারে। সে কারণেই ভাগ করে নেয়া। মীর সিরামিকসটা আমি নিলাম, মীর সিমেন্টটা আমার বড় ভাই নিলেন। অন্য কোম্পানিগুলো দুই ফ্যামেলির মধ্যে আলাদা আলাদাভাবে রয়েছে, তবে আমরা বিগ আমব্রেলা। যেমন আমার ছেলেমেয়েরা মীর সিরামিকস কোম্পানি, মীর হোল্ডিংস দেখাশোনা করছে। এখন আমরা নতুন কিছু অপারেশন শুরু করেছি। মীর টেকনোলজি, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে কাজ করছি।

আমার বড় ভাই মারা যান ২০০৯ সালে। তার ছেলেমেয়েরা কনস্ট্রাকশনে জয়েন করে। সিমেন্টটা তারা দেখাশোনা করছে, তারা ওই প্রতিষ্ঠান ওন করছে। এবং তারা রিয়েল এস্টেটও করছে। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। আমার মেয়ে মাহিরন নাসির এখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে কানাডা থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএস করে এসেছে।

ছেলে রুসনান নাসির কানাডা থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করে এসে এখানে জয়েন করেছে। আমার ছেলে জয়েন করেছে ২০০৯ সালে আর মেয়ে জয়েন করেছে ২০১০ সালে। তারা আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করছে। এছাড়া আমার বড় ভাই বেঁচে থাকতেই ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত হই। তিনি এনসিসি ব্যাংকের সঙ্গে আর আমি ইস্টার্ন ব্যাংকে। ইস্টার্ন ব্যাংকের বোর্ডে আমি বসি।

ভাই মারা যাওয়ার পর এনসিসি ব্যাংকে এখন ভাবি বসেন। ব্যাংকগুলো শুরু করি ১৯৯২ সালে। ১৯৯৬ সালে আমি উদ্যোক্তা হিসেবে অগ্রণী ইনস্যুরেন্স প্রতিষ্ঠা করি। ওখানে আমি ডাইরেক্টর ছিলাম। কিন্তু আইনগত কারণে এখন সেখানে থাকতে পারছি না। সরকার গত বছর একটা আইন করেছে যে, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ডাইরেক্টর একইসঙ্গে ব্যাংকের ডাইরেক্টর থাকতে পারবে না। সুতরাং ইন্স্যুরেন্সটা আমি ছেড়ে দিলাম। এখনও সেখানে কাউকে বসাইনি।

নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে মীর নাসির বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন লিমিটেড দেশের নির্মাণ শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান বলা যায়। পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে গড়ে উঠেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী অনেক প্রতিষ্ঠান, যার ধারা অব্যাহত রয়েছে বর্তমান সময় পর্যন্ত।

১৯৬৮ সালে মীর আকতার হোসেন লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছে ঐতিহ্যবাহী পাঁচ তারকা শেরাটন হোটেল (বর্তমান নাম রূপসী বাংলা হোটেল) থেকে শুরু করে বর্তমানের রেডিসন হোটেল। রাজধানীর দিলকুশাতে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ১৮ তলা ইসলামী ব্যাংক টাওয়ার, তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু, রাজশাহী সিটি করপোরেশন ভবন, ঢাকা-বগুড়া হাইওয়ে, আমেরিকান দূতাবাস, ব্রিটিশ দূতাবাস ভবন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলসহ অনেক বড় প্রতিষ্ঠান।

এছাড়াও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে হাতিরঝিল প্রকল্পে, মিরপুর-বনানী ফ্লাইওভার, খিলগাঁওয়ে ৫০০ বেডের হাসপাতালসহ আরও অসংখ্য ইমারত নির্মাণে। মীর গ্রুপের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান মীর টেলিকম। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটর প্রতিষ্ঠান এটি। ২০০৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে যাত্রা শুরু হয় এ প্রতিষ্ঠানটির।

বাংলাদেশে যে কলগুলো আসে সেগুলো বিদেশ থেকে আনা হয়। এনে আইসিএসের মাধ্যমে গ্রামীণ, রবিসহ অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে বিতরণ করে প্রতিষ্ঠানটি। আবার বাংলাদেশ থেকে যে কলগুলো বিদেশে যায় সেগুলোও আইসিএসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির কাছে আসে এবং সেগুলো বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এটি মূলত একটি ভয়েস এক্সপোর্ট বিজনেস। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে

এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং ওশেনিয়া অঞ্চল থেকে ৩৫০ মিলিয়ন মিনিট আদান-প্রদান করে থাকে। এরপর মীর সিমেন্ট লিমিটেড নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে মুড়াপাড়ায় ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু হয়। উন্নতমানের সিমেন্ট সরবরাহ করতেই পিরামিড ব্র্যান্ড নিয়ে বাজারে আসে প্রতিষ্ঠানটি। মীর সিমেন্ট বাজারে মজবুত অবস্থান করে নিয়েছে এরই মধ্যে। এছাড়া মীর কংক্রিট প্রোডাক্ট লিমিটেড

২০০৪ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে রাজধানীর গাবতলীতে। রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। তাছাড়া মীর রিয়েল এস্টেট লিমিটেড ২০০৬ সালের মার্চ মাসে যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই গড়ে তুলেছে গুলশানে আবাসিক ভবন। এছাড়া ধানমন্ডি, বনানী, শ্যামলী এবং উত্তরাতেও মীর রিয়েল এস্টেট গড়ে তুলছে আরও কয়েকটি আবাসিক ভবন।

২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মীর সিরামিকের যাত্রা শুরু হয়। ইতালিয়ান যন্ত্রাংশ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে গাজীপুরের শেরপুর উপজেলার মাওনাতে। মীর সিরামিকস কারখানা থেকে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন আকারের সিরামিক টাইলস। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা পণ্য রপ্তানি করছি ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং নেপালে। এছাড়া মীর গ্রুপের মীর হোল্ডিংস লিমিটেড ও মীর টেকনোলজি লিমিটেড নামের আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা তো বলেছি।

আমরা এখন টেকনোলজির প্রতি জোর দিচ্ছি। আমার নেক্সট জেনারেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ডের। আমার মেয়ে জামাই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছে কানাডা থেকে, বুয়েট থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে। সে কারণে আমি টেকনোলজি সাইটে ফোকাসটা বেশি করতে চাই।

এফবিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মীর নাসির হোসেন বলেন, আমি ২০০৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত এফবিসিসিআই’র সভাপতি ছিলাম। আমি প্রথম বোর্ডে আসি ১৯৮৪ সালে। কিন্তু আমি এফবিসিসিআই’র সঙ্গে সম্পৃক্ত হই ১৯৭৮ থেকে, ফরিদপুর চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে। তারপর প্রথম বোর্ডে আসি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাহেব যখন প্রেসিডেন্ট হলেন তখন। তার সময় আমি বোর্ডে আসি। পরের টার্মে কাশেম সাহেবের সময়ে আমি ডাইরেক্টর ছিলাম।

পরবর্তী সময়ে সালমান এফ রহমান, ইউসুফ হারুন, আবদুল আউয়াল মিন্টুর সময়েও বোর্ডের ডাইরেক্টর ছিলাম। তারপর তো আমি নিজেই প্রেসিডেন্ট হলাম। আমি সার্ক চেম্বারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই ১৯৯২ সালে। চার-পাঁচ বার বোর্ড অব ডাইরেক্টর ছিলাম সার্ক চেম্বারের। সার্ক চেম্বারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দুই বছর কাজ করেছি ২০০৬ সাল থেকে।

নিজের ব্যবসায়িক সাফল্যের রহস্য সম্পর্কে মীর নাসির বলেন, আমি যেটা মনে করি, এখন মেধার সময় এসেছে। যারা নতুন নতুন জিনিস আনতে পারবে তারা সফল হবে। দ্বিতীয়ত সাফল্যের কোন শর্টকাট পথ নেই। পরিশ্রম করতে হবে। নিষ্ঠাবান হতে হবে। মীর গ্রুপের সফলতার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়ে কাজ করা। এছাড়া, সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং কমিটমেন্ট বজায় রাখা।

মীর নাসির হোসেন দেশের অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে। সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ডা. জাহিদ নামে আমাদের এক বন্ধু যিনি ব্যাংকার ছিলেন। আগে বামপন্থি রাজনীতি করতেন, পরে সমাজসেবায় নামেন। তিনি কিছু প্রতিষ্ঠান করার চেষ্টা করলেন এবং আমাদেরকেও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করলেন। ফরিদপুরে ডা. জাহিদ মেমোরিয়াল হসপিটাল, শিশু চিকিৎসাকেন্দ্র করলেন।

প্রতিষ্ঠাতা তিনি, আমরা তার সহযোগী ছিলাম। সেটা এখন দেড়শ’ বেডের হাসপাতাল। তিনি ফ্রি চিকিৎসা দেন। তারপর ডায়বেটিকস এসোসিয়েশন, অন্ধ কল্যাণ সমিতি করলেন। এসব কাজে তার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিলাম আমি। সে কারণে তার সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি ফরিদপুর লায়ন্স ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম ’৭৬ সাল থেকে।

ক্রমান্বয়ে আমি ১৯৯৫ সালে লায়ন্স ক্লাবের গভর্নর ছিলাম। তখন ক্লাবের মাত্র দুটি শাখা ছিল। ফরিদপুর চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এফবিসিসিআই’র সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। মীর নাসির বলেন, কর্মই হচ্ছে জীবনের ধর্ম। জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছা সম্পর্কে মীর নাসির বলেন, এখন আকাঙ্ক্ষা হলো- মানুষের জন্য যত করতে পারি। আমার গ্রামের বাড়িতে একটা হাসপাতাল করার ইচ্ছা আছে। এর জন্য জমি খুঁজছি। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর