এক খুনের জট খুলতে খুলল আরেক খুনের জট

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এক নারীর খুনের জট খুলতে গিয়ে পুলিশ আরেক নারীর ক্লুলেস খুনের জট খুলেছে। এক মাস আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ময়লার ভাগাড় থেকে উদ্ধার নারীর (অজ্ঞাত) পোড়া ও অর্ধগলিত লাশের রহস্য বের হয়নি। তবে ওই খুনের রহস্য খুলতে গিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারী বিভাগ চট্টগ্রামের রাউজানের এক নারীর (আমেনা খাতুন) হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করেছে।

রাউজান থেকে উদ্ধার আমেনা খাতুনের বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎ আমেনা নিখোঁজ হন। এর প্রায় এক মাস পর যাত্রাবাড়ীতে উদ্ধার লাশের হাতের চুড়ি ও শরীরিক চিহ্ন (পায়ের আঙুল) দেখে আমেনার মা-বাবা তাদের মেয়ের লাশ চিহ্নিত করেন। এ সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তবে তদন্তে ভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসে। যাত্রাবাড়ী থেকে উদ্ধার হওয়া নারী আমেনা নন। এখনো এটির পরিচয় জানা যায়নি। ১৬ ডিসেম্বর রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে পাওয়া লাশটি অজ্ঞাতপরিচয় হিসাবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ জানান, যাত্রাবাড়ী থেকে উদ্ধার নারীর লাশ নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে রাউজানে একই ধরনের ক্লুলেস ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছি। ২০ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে এসে এক দম্পতি (আমেনার মা-বাবা) দাবি করেন, নভেম্বর থেকে তাদের মেয়ে আমেনা নিখোঁজ। তারা জানতে চান- যাত্রাবাড়ী থেকে উদ্ধার লাশের সঙ্গে কিছু পাওয়া গেছে কি না। লাশের সঙ্গে পাওয়া দুইটি চুড়ি দেখানো হলে আমেনার বাবা নূর হোসেন বলেন, এটি তাদের মেয়ের চুড়ি। আমেনার মা শফিদা বেগম বলেন, এ চুড়ি দুইটিই আমি একসময় পরতাম। মর্গে লাশের পায়ের আঙ্গুল দেখে তারা নিশ্চিত করেন।

পুলিশ কর্মকর্তা শাহ ইফতেখার জানান, আমেনার মা-বাবার তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত শুরু করি। তদন্তে দেখা যায়, ১৯ নভেম্বর থেকে আমেনার ফোন নম্বর বন্ধ। সন্দেহভাজন কোনো নম্বরও পাওয়া যাচ্ছিল না। মা-বাবার ডিএনএ-এর সঙ্গে ভিকটিমের ডিএনএ ম্যাচিং করার জন্য সিআইডিতে নমুনা পাঠানো হয়। তবে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মুকিত হাসানকে কক্সবাজারে পাঠাই।

শাহ ইফতেখার জানান, তদন্তের একপর্যায়ে মেয়েটির (আমেনা) মোবাইল ফোন সচল হয়। ফোনটির অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের স্টেশন রোডে। ফোনটি বহনকারীকে (আকতার হোসেন) দ্রুতই গ্রেফতার করা হয়। আকতারকে গ্রেফতারের পর জানা যায়, ফোনটি নুরুল ইসলাম ওরফে বাদশা (আমেনার স্বামী) তাকে দিয়েছে। বাদশাকে আটক করা হলেও সে ঘটনা স্বীকার করছিল না। তবে একপর্যায়ে তারা বলেন, আমেনাকে নিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় তারা কাপ্তাই লেকে ঘুরতে গিয়েছিল। এরপর সিএনজিচালক মো. মিরাজকে আটক করা হয়। তাদের ঢাকায় নিয়ে এলে তারা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। তারা জানায়, হত্যার পর আমেনার লাশ রাউজানের পূর্ব গুজরায় ফেলে দেওয়া হয়।

পুলিশ জানায়, কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা বাদশার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আমেনা। বাদশা বিবাহিত ও তার সন্তানও আছে। আমেনা বিয়ের জন্য চাপ দিলে বাদশা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। এরপর আমেনা ধর্ষণ মামলা করেন। এক পর্যায়ের বিয়ের শর্তে আদালত বাদশাকে জামিন দেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে আমেনাকে বিয়ে করে বাদশা। তবে কিছুদিন পর সে আমেনাকে তালাক দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাদশার বিরুদ্ধে আমেনা যৌতুকের মামলা করেন। এ মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর বাদশা জামিন পাচ্ছিল না। আমেনাকে বাদশা প্রস্তাব দেয়, ‘আমাকে জামিনে বের করার ব্যবস্থা কর। তোমাকে আমি আবার বিয়ে করব এবং আলাদা বাসা নিয়ে আমরা চট্টগ্রামে থাকব।’ এ শর্তে আমেনা রাজি হন। জামিন পাওয়ার পর বাদশা পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে আমেনাকে নিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। চার-পাঁচদিন একসঙ্গে থাকার পর ১৫ নভেম্বর তারা বিয়ে করেন। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডে তিন হাজার টাকায় তারা একটি ঘর ভাড়া নেন। এ বিষয় তার আগের ঘরের স্ত্রী-সন্তান জেনে যায়। এরপর দুই পরিবারকে রক্ষা করার চেষ্টা চালায় বাদশা। এ নিয়ে বাদশা ও আমেনার মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি হয়। এর জের ধরে আমেনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে বাদশা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ নভেম্বর বাদশা তার বিয়াই আক্তার ও মিরাজ (সিএনজিচালক) মিলে আমেনাকে কাপ্তাই লেক দেখতে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর তারা সিএনজি দিয়ে ঘোরাফেরার নামে সময়ক্ষেপণ করে। একপর্যায়ে সিএনজির ভেতর শ্বাসরোধ করে আমেনাকে হত্যা করে রাউজানের পূর্ব গুজরার রাস্তার পাশে লাশ ফেলে রাখে।

রাউজান থানার ওসি বলেন, ১০ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারী বিভাগ আমাদের কাছে তিনজনকে হস্তান্তর করেছে। ১১ জানুয়ারি তাদের আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তারা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, এ মামলায় শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর