পর্যটনে ফের করোনার থাবা কক্সবাজারে শঙ্কা, সুন্দরবনের নীরব কান্না

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সমুদ্র সৈকত, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা, থানচি-আলিকদম-রুমা- রোয়াংছড়ি, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, সাজেক, খাগড়াছড়ির আলুটিলা, রিসাং ঝর্ণা, সিলেটের বিছানাকান্দি, সাদাপাথর, জাফলং, চাবাগান, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, খুলনার সুন্দরবন, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ডের ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশার ছায়া
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও প্রতিবছরই পর্যটন খাতে আয় বাড়ছে বাংলাদেশের। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। দেশে পর্যটনের সময় ধরা হয় অক্টোবর থেকে মার্চ এ ছয় মাস। ভ্রমণপিপাসু বাংলাদেশীরা সময় পেলেই ছুটে যান দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সুন্দরবন, সিলেটসহ সারা দেশে বিভিন্ন জেলায় প্রায় অর্ধশত পর্যটন স্পট গড়ে উঠেছে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে। এসব স্পট ঘিরে কয়েক লাখ মানুষের চলে কর্মযজ্ঞ। করোনার কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ ছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই এবার দেশের পর্যটন এলাকাগুলো মুখরিত হয়ে উঠে। লাখ লাখ পর্যটক দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভিড় করেন। প্রাণচাঞ্চল্য হয়ে উঠে পর্যটন এলাকাগুলো। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন আবার থাবা বসাচ্ছে পর্যটন ব্যবসায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে। মার্কেট, শপিংমলে স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। খুলনা থেকে সুন্দরবনগামী সব লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে পর্যটন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘদিন পর পর্যটন ব্যবসা জমে উঠেছিল। দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ থেকে শুরু করে পর্যটন কেন্দ্রের হোটেল, মোটেল, রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা, মার্কেট, খাবার হোটেল এমন কি খেলনা বিক্রেতা জমিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু করোনার নতুন বিধিনিষেধে নতুন করে সংকটের তৈরি করল।

বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পর্যটন খাতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের। জাতীয় আয়ে এ খাতের অবদান ছিল ৯৫০ দশমিক ৭ বিলিয়ন টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে তা ৬ শতাংশে পরিণত হবে। ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের থাবায় স্থবির হয়ে যায় পুরো খাত। করোনা টিকা দেয়া শুরু হলে আবারও ধীরে ধীরে খুলে যায় পর্যটনের দুয়ার। তবে দেশের বাইরে যেতে যুক্ত হয়েছে করোনা সার্টিফিকেট, টিকার সার্টিফিকেটসহ নানা শর্ত। অন্যদিকে দেশের ভেতরেই পর্যটন এলাকাগুলো কাছে টানছে সাধারণ মানুষকে। ফলে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেই বাড়তে থাকে চাপ। কক্সবাজারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা, থানচি-আলিকদম-রুমা-রোয়াংছড়ির বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, সাজেক, খাগড়াছড়ির আলুটিলা, রিসাং ঝর্ণা, সিলেটের বিছানাকান্দি, সাদাপাথর, জাফলং, চাবাগান, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, খুলনার সুন্দরবন, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ডসহ সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রকৃতির লীলাভ‚মি। আর এসব দেখতে প্রতিদিনই ছুটে যান প্রকৃতিপ্রেমিরা। ছুটির দিনগুলোতে এসব স্পটে থাকে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। পর্যটনে যাদের সংসার চলে তারাও খুশি হয়ে উঠেন দীর্ঘদিন পর পর্যটকদের ভিড়ে। কিন্তু করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আঘাত শুরু হলে নতুন করে সারা দেশে বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয় সরকার। আর এতে পর্যটনের ভরা মৌসুমে বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বান্দরবানের থানচি থেকে পর্যটকদের গাইড হিসেবে দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখান মং। বিধিনিষেধ আরোপের পর গতকাল তিনি বলেন, বিগত কয়েক মাস ধরেই প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পর্যটক ঘুরতে এসেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে আবার করোনা বেড়ে যাওয়ায় পর্যটক কমে যাওয়া শুরু হয়েছে। মং বলেন, এমনিতেই দেড় বছর ধরে আমরা যারা পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছি। ওই সময় সংসার চালাতে গিয়ে ধারদেনা করতে হয়েছে। এখনও সেগুলো শোধ করতে পারিনি। এখন যে অবস্থা শুরু হয়েছে তাতে কি অবস্থা হবে বলা কঠিন।

আলিকদমের আরেক গাইড কাউছার হোসেন বলেন, এখনো পর্যটক আসছে। তবে করোনা যেভাবে বাড়ছে তাতে আমরা যারা এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য অসনিসংকেত।
খাগড়াছড়িতে রিসোর্ট পরিচালনা করেন রঞ্জনা সৌমী। তিনি ভেবেছিলেন করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার ফলে যেভাবে পর্যটন শিল্প আবারও নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তাতে বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে কিছুটা লাভ করতে পারবেন। কিন্তু বছরের শুরুতেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় সব ভেস্তে যেতে পারে। রঞ্জনা সৌমী বলেন, একে তো করোনার কারণে দেড় বছর রিসোর্টগুলো থেকে কোন আয় নেই, উল্টো এই রিসোর্ট দেখভালে তাকে খরচ করে যেতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। বিনিয়োগ যা করার করে ফেলেছি। কিন্তু আয় না থাকলেও রিসোর্ট মেইন্টেইন করতে খরচ করতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে কর্মচারীদের ছাঁটাইও করেছি। যাদের একটা দুটা কটেজ, আর এগুলোর আয় দিয়েই চলে তাদের অবস্থা খুব খারাপ।

কক্সবাজারে বাড়ছে পর্যটন শিল্পে শঙ্কা
কক্সবাজার ব্যুরোর শামসুল হক শারেক জানান, পর্যটন শিল্পে আবারও নেমে আসছে বিপর্যয়। ইতিপূর্বে করোনাকালীন সময়ে দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এতে পর্যটন শিল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এবারও করোনার তৃতীয় ঢেউতে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় আবারো থেমে গেল কক্সবাজারে পর্যটক আসার স্রোত। কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনে খবর নিয়ে জানা গেছে করোনা বিধিনিষেধ ঘোষণার পরে ইতোমধ্যেই হোটেল-মোটেলে কমে গেছে ৫০ভাগ বুকিং। গত ২ বছরে কক্সবাজারের শত শত হোটেল-মোটেল ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে করোনালকডাউন উঠে গেলে স্বাভাবিক হতে শুরু করে পর্যটন ব্যবসা। এরই মধ্যে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা তাদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওটার ব্যাপারে আশাবাদীও হয়েছিল। কিন্তু এখন ভর পর্যটন মৌসুমে আবারও করোনা বিধিনিষেধ পর্যটন শিল্পে নতুন করে ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার শুক্রবারেও যেখানে কক্সবাজার সৈকতে ছিল লাখো পর্যটকের পদচারণায় মুখর। সেখানে যেন হঠাৎ করেই বাজ পড়েছে। কমে গেছে পর্যটকদের সেই পদচারণা। পাশাপাশি কমে গেছে হোটেল-মোটেলে বুকিং এবং পর্যটকদের বাঁধভাঙা স্রোত। এদিকে অভিজ্ঞ মহলের মতে দেশের অন্যান্য খাতের মতো বিধিনিষেধ প্রতি পালনের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পও চাঙা রাখা যেতে পারে। নতুবা আবারো বিপর্যয় নেমে আসবে দেশের পর্যটন শিল্পে।

সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীলদের নীরব কান্না
মোংলা থেকে মনিরুল ইসলাম দুলু জানান, নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের নতুন নিষেধের কারণে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের মাঝে উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তাদের ভাষ্য সরকারের এই নিষেজ্ঞার কারণে ধস নামবে সুন্দবন পর্যটনশিল্পে। আবার জীবন বাঁচাতে নতুন করে লড়াই করতে হবে পরিবার পরিজন নিয়ে নির্ভরশীল এ পেশার লোকদের। তবে এ সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার যদি তাদের জন্য প্রণোদনা দেন তাহলে শান্ত¦নার জায়গা পাবে। অন্যদিকে বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তাদের হাতে এই রকম কোন পরিকল্পনা নেই ।

ট্যুরিস্ট ব্যবস্যায়ী তালুকদার আব্দুল কাদের জানান, আমরা ৩ হাজার ট্যুরিস্ট বোট ব্যবসায়ী দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সুন্দরবনে আনা নেয়ার কাজের সাথে জড়িত। করোনা মহামারির কারণে পর্যটক আসা কমে গেছে। এর ফলে এই পেশার লোকজন আবার অভাব অনাটনের মধ্যে পড়বে। আমরা যাতে একেবাবে বেকার হয়ে না পড়ি তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ।

মোংলার একটি নামকরা আবাসিক হোটেল সিঙ্গাপুর এর মালিক তালুকদার আখতার ফারুক জানান, আমাদের হোটের ব্যবসা মূলত পর্যটকনির্ভর। আমরা আসায় থাকি ৪ মাসের ব্যবসা দিয়ে পুরো বছর চলতে হবে। এবার দেখছি করোনার আতঙ্কে আগে থেকেই লোকজন আসা কমে গেছে। যা এই ব্যবসার জন্য আশনি সঙ্কেত ।

সুন্দরবনের পর্যটন স্পট করমজরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, পর্যটক সুন্দরবনের আসতে পারবে কি পারবে না তার কোনো অর্ডার এখনও আমি পাইনি। তবে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সুন্দরবনে লোকজন আসা কমে গেছে। বর্তমানে প্রতিদিন থেকে ৩০০ পর্যটক আসছে। অন্যান্য বছর একই সময় ৩ থেকে ৪ হাজার লোক সুন্দবনের বেড়াতে আসত।

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দবনের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা যাতে বেকার হয়ে না যায় তার জন্য তাদের প্রণোদনা দেওয়া উচিত। এই পেশার লোকজন বেকার হয়ে গেলে পর্যটন শিল্পের উপর প্রভাব পড়বে ।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার জানান, সরকারের যে নির্দেশনা আছে সেটি সকলকে মানতে হবে। তবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীলদের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয় তার মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

পর্যটন নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প এরই মধ্যে করোনার কারণে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে। আর প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেলস এসোসিয়েশনের রিপোর্ট অনুযায়ী করোনা শুরুর প্রথম ৬ মাসে ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এজন্য হোটেল, রেস্তোরাঁ বা বিনোদন স্পটগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, বিশেষ করে যারা সেবা নেবেন বা যারা সেবা দেবেন, তাদের আচরণ কেমন হবে, সে ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কথাও জানান সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট পর্যটন উদ্যোক্তা আলহাজ্ব আবুল কাশেম সিকদার বলেন, গেল বছরের শেষের দিকে করোনালকডাউন প্রত্যাহার হলে চাঙা হয়ে ওঠে পর্যটন শিল্প। এরই মধ্যে বেশ ভালোই পর্যটক আসছিলেন কক্সবাজারে। কিন্তু হঠাৎ করে আবারো করোনা বিধিনিষেধে থমকে গেছে সেই পর্যটক স্রোত। কমে গেছে হোটেল-মোটেলে বুকিং। তিনি আরো বলেন, আমরা আশঙ্কা করছি করোনা বিধিনিষেধ পর্যটন শিল্পে অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে আবুল কাশেম সিকদার বলেন, সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ প্রতিপালন করে তারা পর্যটক সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। তিনি বিধিনিষেধ প্রতিপালন করে পর্যটকদের কক্সবাজার ভ্রমণর আহবান জানান।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর