এখন রাতে ভালোবাবে ঘুম আসে না, শরীর থেকে পোড়া গন্ধ পাই

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আগুনে পুড়ে যাওয়া লাশ দেখার পর জীবনযাপন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে মৃতদের দাফনে সহায়তকারীদের। কত দিনে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

এমনই একজন সহায়তাকারী বরগুনা পুলিশ লাইন্স এলাকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি স্থানীয় একটি কলেজে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।মামুন বলেন, কিছু লাশ কবরে নামানোর সময় মনে হচ্ছিল, যেন কয়েক টুকরো কয়লা নামিয়ে রাখছি।

বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালী গণকবরে ২৩টি লাশের মধ্যে তিন থেকে চারটি লাশের আকৃতি ছিল। বাকি লাশের কোনো আকৃতি ছিল না। আকৃতি বলতে একটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কালও ছিল না বলে উল্লেখ করেন মামুন।

অজ্ঞাত লাশের জানাজায় যোগ দিতে গিয়ে নিজেকে দাফনকাজে জড়িয়ে ফেলা এই যুবক বলেন, একটি লাশবহনকারী কফিনের নিচের কাঠ ছুটে গিয়েছিল। সেটি মেরামত করতে গিয়ে কফিন ধরি। এরপর মন থেকে টান দেয় যেন এই কাজে যুক্ত থাকি। এখানে যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের যদি স্বজনরা শনাক্ত করতে পারত, তাহলে আরও ভালোভাবে দাফন হতো। এমন পরিণতি আমারও হতে পারত।

মামুন বলেন, দাফনের পর এখানে আমি আর আসতে চাইনি। কারণ লাশের আকৃতি এমন ছিল যে আমি তাদের রক্তের আত্মীয় না হয়েও আমার বুক কেঁপে উঠছে। আর যার সঙ্গে এমন ঘটনা বা যাদের স্বজনরা এমন পরিণতির শিকার হয়েছেন তাদের অবস্থা কী তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

সোহানুর রহমান সৈকত বরগুনা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত আছেন রোভার স্কাউটে। তিনিও নিজ হাতে লাশ কফিন থেকে বের করা, গণকবরে নামানোর কাজ করেছেন। অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিতে বলেন, হাসপাতালে লাশগুলো প্যাকেটে এসেছে। যেন বারবার সেই প্যাকেটের মুখ খুলতে না হয় এজন্য প্রতিটি লাশের ছবি মোবাইলে তুলেছি। সেই ছবিগুলো প্রিন্ট করে কফিনের গায়ে লাগানো হয়, যদি কোনো স্বজন লাশ শনাক্ত করতে পারেন।

যতগুলো লাশ নিয়ে আসা হয়েছিল তার মধ্যে ৭-৮টি লাশ মোটামুটি মানুষের আকৃতির ছিল। সেগুলো তাদের স্বজনরা শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন। এছাড়া যতগুলো লাশ ছিল সেগুলোর বর্ণনা করার ভাষা নেই উল্লেখ করে বলেন, এত নির্মমভাবে ওই মানুষগুলো পুড়েছে যা দেখে বলা মুশকিল এগুলো মানুষ কিনা। একেবারে কয়লা। তারা পুরুষ নাকি মহিলা সেটা বোঝারও কোনো অবস্থা ছিল না।

সোহান বলেন, অনেকেই কফিনের ওপরের ছবি দেখেছেন। কিন্তু তারা যদি সরাসরি লাশগুলো দেখতেন তাহলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এর মধ্যে এক জোড়া লাশ ছিল তাদের আলাদা করার কোনো অবস্থা ছিল না। কবরের প্রথম সারির প্রথম কবরে তাদের দাফন দেওয়া হয়েছে। লাশ দুটি ছিল মা ও তার আদরের সন্তানের।

সবগুলো লাশ দাফন কার্যক্রমের শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন উল্লেখ করে এই স্বেচ্ছাসেবক বলেন, যার স্বজন হারিয়েছে তিনিই বোঝেন এই কষ্ট প্রকাশের ভাষা পৃথিবীতে নেই।

সোহান বলেন, এই মানুষগুলোকে দাফন করার পর থেকে রাতে আমার ঘুম আসে না। যেন নিজের শরীর থেকে পোড়া গন্ধ আসে বলে বিভ্রম হয়। আমার সব সময় খারাপ লাগছে। জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হব নিজে তা কখনো কল্পনাও করিনি।

এই স্বেচ্ছাসেবক বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কখনও চাইব না একজন মানুষের এমন মৃত্যু হোক। এমন মর্মান্তিক মৃত্যু যেন শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বে যেন কোথাও না হয়।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান  জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের মরদেহ গ্রহণ করেছে বরগুনা জেলা প্রশাসক। এর মধ্যে ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি বলে তাদের গণকবরে দাফন করা হয়েছে। বাকিদের শনাক্ত করে তাদের স্বজনরা নিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত নিহতদের ২৫ হাজার টাকা সহায়তা করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্তের জন্য এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকি আরও দুজনের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) রাত ৩টার দিকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী অতিক্রমকালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাদের বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালীতে গণকবর দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বরগুনা, ঝালকাঠি ও ঢাকায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় লঞ্চের মালিকসহ পাঁচজন কারাগারে রয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর