সিডরের ১৪ বছর পরেও স্মৃতি উপকূলবাসীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আজ ১৫ নভেম্বর। বরগুনাসহ উপকূলবাসীর জন্য একটি স্মৃতিময় বেদনার দিন। ২০০৭ সালের এ দিনে ঘূর্ণিঝড় সিডর লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ।

সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও উপকূলবাসীকে মনে করিয়ে দেয়। অনেক পরিবারের কান্না এখনও থামেনি। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৭টা ৪০ মিনিট। মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত বরগুনা উপকূলের মানুষ। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছে। সচেতন মানুষেরা যেতে শুরু করলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। বেশির ভাগ মানুষই রয়ে গেলেন বাড়িতে। তাদের ধারণা ছিল, কত ঝড়ই এলো-গেল, এবারও তাদের কিছু হবে না।

সিডর আঘাত হানতে শুরু করেছে উপকূলীয় এলাকায়। মানুষের ঘর যেন এখনই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তার সঙ্গে যুক্ত হলো পানিপ্রবাহ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরের সব পানি এসে মানুষগুলোকে নাকানি-চুবানি দিয়ে কেড়ে নিতে শুরু করল। মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। পুরো এলাকা হয়ে গেল লণ্ডভণ্ড। সকালে মনে হলো কেয়ামত হয়ে গেছে।একের পর এক মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে। কবর দেওয়ার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এক একটি কবরে দুই থেকে তিনজনের মরদেহ ফেলে মাটিচাপা দেওয়া হলো। সিডরের এত বছর পরেও নিহতের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী সিডরের আঘাতে বরগুনা জেলার ১ হাজার ৩৪৫ জন মানুষ মারা গেছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদিপশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাস-মুরগি মারা যায়। জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবারের সবাই ক্ষতির শিকার হন। সম্পূর্ণভাবে গৃহহীন হয়ে পড়ে জেলার ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। বেসরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার।

সিডরে মৃত্যুর অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ওই সময় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবার্তা যথাযথ ছিল না। আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে হঠাৎ করে ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের কথা ঘোষণা করে। মোংলা সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে যে সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। রেডক্রিসেন্টের সেচ্ছাসেবকরা ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয়। দু-এক জায়গায় তারা মাইকিং করলেও বেশির ভাগ জায়গায়ই কোনো রকম সংকেত প্রচার করা হয়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য অফিস মাইকিং করলেও তা ছিল শহর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যারাও ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনেছেন, তারাও পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি। ‘

জাগো নারী’র প্রধান নির্বাহী হোসনেয়ারা হাসি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কসংকেত স্থানীয় ভাষায় বোধগম্য করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সিপিপির টিম লিডার জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, ঘূর্নিঝড় কর্মসূচির সেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার নাম নলটোনা। যেখানে সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ছিল না। সিডরের সময় সেখানে ২০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের মরদেহ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছিল।

মরদেহ দাফনের জন্য কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মরদেহগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ২৯ জনকে ১৯টি কবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

বর্তমান জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় সেখানে সিডর স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছেন। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এসে থমকে দাড়ায়। কেউ কেউ কান্না চেপে রাখতে পারেন না। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে কবরগুলো।

সিডরে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ আজও মেরামত হয়নি। সামান্য জোয়ারের পানি বাড়লেই নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে উপকূলের মানুষ।

বরগুনা পানি উন্নয়নের বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইসার আলম জানান, সিডরের পরে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য সিআইপির মাধ্যমে দুটো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে; যার কাজ এখনও চলছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর