কিশোরগঞ্জ অষ্টগ্রামে ঐতিহ্য কুতুবশাহী মসজিদ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে হাওরের জন্য বিখ্যাত হলেও সেখানে আছে ঐতিহাসিক নানা স্থান। তার মধ্যে অন্যতম কুতুবশাহী মসজিদ।

৪০০ থেকে ৫০০ বছর আগের মসজিদটিকে ১৯০৯ সালে সংরক্ষিত পূরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে এত দিন ঐতিহাসিক নিদর্শনটি দেখতে যেত কম মানুষই।

সম্প্রতি হাওরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার পর সেখানে বেড়েছে পর্যটকদের আনাগোনা। ২০২০ সালের ৪ আগস্ট মসজিদটিকে সংস্কারও করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে ময়মনসিংহসহ ওই এলাকার সবচেয়ে পুরোনো স্থাপনা হিসেবে ধরা হয়। এর নির্মাণশৈলীতে রয়েছে সুলতানি ও মোগল আমলের ছাপ।

দুই সময়ের নির্মাণশৈলী ও কোনো নির্মাণফলক না থাকায় মসজিদটি নির্মাণের সময় নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মসজিদটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে বলে মনে করেন।

হযরত শাহ কুতুব ইয়ামিনীর (র.) মাজার রয়েছে মসজিদটির পাশে। তার নামেই এ মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, তার অনুসারীরা মসজিদটি নির্মাণ করেন।

কারুকার্যখচিত আয়তকার মসজিদটির বাইরের দেয়ালে আছে পোড়ামাটির চিত্রফলক, প্যানেলে আছে কারুকাজ। মসজিদের ছাদে পাঁচটি গম্বুজের মধ্যে মাঝেরটি বড়। বাকি চারটি একটু ছোট। এর উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটি করে চারটি এবং পূর্ব পাশে তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে। এগুলো সুলতানি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ।

এ ছাড়া মসজিদের পূর্ব পাশের প্রবেশপথের বিপরীতে তিনটি মেহরাব রয়েছে। মসজিদের পশ্চিম পাশে রয়েছে কুতুবশাহের কবর। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে আরও পাঁচটি কবর। এগুলো কুতুবশাহের সফরসঙ্গীদের বলে কথিত আছে। মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ২০ জন খাদেমের কবরও রয়েছে।

মসজিদটিতে ৩৫ বছর ধরে খাদেমের দায়িত্ব পালন করছেন হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ। কিছুদিন আগে তিনি চেরাগী খাদেমের দায়িত্ব পেয়েছেন।

তিনি জানান, এই মসজিদে আরও ৭ খাদেম রয়েছেন। তারা সবাই বংশপরম্পরায় দায়িত্ব পেয়েছেন। বর্তমানে খাদেমদের মধ্যে সবার মুরব্বি মরসন্দ আলী শাহ ফকির। তিনি অসুস্থ থাকায় এখন দায়িত্ব পেয়েছেন আব্দুল আজিজ।

আব্দুল আজিজ জানান, হযরত শাহ কুতুব ইয়ামিনী (র.) ৫৯০ হিজরিতে আরবের ইয়ামীন প্রদেশ থেকে ১২ জন সফরসঙ্গী নিয়ে এখানে আসেন ইসলাম প্রচারের জন্য। এখানে তার কবর রয়েছে। ধারণা করা হয়, তার অনুসারীরা পরবর্তী সময়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দাদাদের মুখ থেকে শুনেছি, ইংরেজ শাসনামলেও এই মসজিদে একটি শিলালিপি ছিল। পরে ইংরেজরা সেই শিলালিপিটি গায়েব করে ফেলে। ফলে এর সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে পারে না।’

মসজিদের আরেক খাদেম হযরত মাওলানা আবদুস সামাদ শাহ ফকির জানান, ১৯০৯ সালে সরকার ঐতিহাসিক এই মসজিদটিকে সংরক্ষিত পূরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করলেও যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় স্থানীয় লোকজন ছাড়া সেখানে বাইরের কেউ তেমন যেত না। এখন রাস্তা ভালো হওয়ায় প্রতিদিনই দর্শনার্থী আসেন।

তিনি আরও জানান, প্রতিবছরের মাঘ মাসের শেষ শুক্রবারে এখানে ওরস শরিফ পালন করেন তারা। এ ছাড়া বুধবারে মাজারে কোরআন খতম এবং মাজারে গিলাফ ছড়ানো হয়। বৃহস্পতিবার হয় ওয়াজ মাহফিল।

আবদুস সামাদ বলেন, ‘প্রতিবছরই এ অনুষ্ঠানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ এখানে জড়ো হন। অনেকে এখানে এসে মানত করে যান। মনের বাসনা পূরণ হলে মসজিদে এসে মানত পূরণ করেন। পুরো উপজেলার বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি এই মসজিদ জিয়ারতের মাধ্যমে তাদের নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন।’

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুবশাহী মসজিদটি বাংলার সুলতানি ও মোগল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যে নির্মিত।

বিখ্যাত দরবেশ কুতুব শাহের নামানুসারে আয়তকার মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে দৈর্ঘ্য ৪৬ ফুট ১১ ইঞ্চি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৭ ফুট ১১ ইঞ্চি। বাংলার চৌচালা ঘরের চেয়ে এর কার্নিশগুলো বেশি ঢালু। মসজিদের চার পাশে আট কোণ বিশিষ্ট চারটি মিনার রয়েছে।

অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল আলম বলেন, ‘কুতুবশাহী মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। এই মসজিদের দেখভাল করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তাদের নির্দেশনা ছাড়া আমরা মসজিদে কোনো কাজ করতে পারি না।

‘তবে মূল স্ট্রাকচারের বাইরে সৌন্দর্যবর্ধন বা রাস্তাঘাট, ওয়াশরুম বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজগুলো করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। আমার স্থান থেকে মসজিদটির সৌন্দর্যবর্ধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর