এক যুগে কৃষি উদ্ভাবনে ঈর্ষণীয় সাফল্য

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশের কৃষিতে গত এক যুগের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও কৃষি উৎপাদন এবং নতুন নতুন জাত আবিষ্কারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। কৃষিতে অভাবনীয় এ সাফল্যের পেছনে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার ও যন্ত্রের ব্যবহার প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া বিশেষ অবদান রাখছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।

গত এক যুগে দেশে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় প্রচুর উচ্চ ফলনশীল, স্বল্পমেয়াদী ও পরিবেশ সহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। যার ফলে ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।

১৯৯৬ সাল থেকেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম নজর দিয়েছিল কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে। যার ফলশ্রুতিতে মাত্র পাঁচ বছরে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। কিন্তু ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশ আবার খাদ্য ঘাটতি এবং আমদানি নির্ভর অবস্থায় ফিরে যায়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার দেশের কৃষির উন্নয়নে পদক্ষেপের কারণে ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, চা উৎপাদনে ৪র্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম স্থানে রয়েছে।

২০০৮-০৯ সালে যেখানে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টনে। বিগত ১২ বছরে বৈরি পরিবেশ সহনশীল জাতসহ মোট ৬৫৬টি উন্নত/উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবিত হয়েছে। এর মধ্যে বারি বিভিন্ন ফসলের ২৮৭টি জাত, ব্রি ৫৮টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত, বিজেআরআই ১৪টি পাটের জাত, বিএসআরআই ৮টি আখের জাত, সিডিবি ৭টি তুলার জাত, বিনা ৫টি ফসলের ৭১টি জাত উদ্ভাবন করেছে।

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ধানের জাতের মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা সহনশীল ১৩টি জাত, জলমগ্নতা সহিষ্ণু ৬টি, খরা সহিষ্ণু ১০টি, জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত ৬টি, কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (লোজিআই) ৩টি, উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী ধানের জাত ৩টি এবং হাওর অঞ্চলের উপযোগী ১১টি জাত রয়েছে। সে সঙ্গে জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে।

সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি। ধান ধরে হিসাব করলে তা ৬ টন। তাছাড়া হেক্টর-প্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বে গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে বর্তমানে চতুর্থ অবস্থানে:
আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। কৃষির এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন।

সবজি উৎপাদনে তৃতীয়:
দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে গত এক যুগে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। একসময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই কেবল সবজির চাষ হতো। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে।

মাছ উৎপাদনে চতুর্থ বাংলাদেশ:
একসময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার ও যন্ত্রের ব্যবহার আধুনিকতার ছোঁয়া প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এতে বিশেষ অবদান রাখছেন দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা। দেশে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় প্রচুর উচ্চ ফলনশীল, স্বল্পমেয়াদী ও পরিবেশ সহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। যার ফলে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ং সম্পন্ন।

তিনি বলেন, কৃষকেরা যাতে কৃষিকাজ করে লাভবান হতে পারে, উন্নত সমৃদ্ধ জীবন পেতে পারে সে লক্ষ্যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেজন্য কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত ও ভ্যালু অ্যাড করতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করছে সরকার। কৃষিকে লাভজনক ও কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে বিদেশে কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়াতে হবে। সেজন্য, কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধিতে রাজধানীর পূর্বাচলে ২ একর জমিতে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক প্যাক হাউজ এবং অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, গত ১২ বছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কৃষিতে নীরব বিপ্লব হয়েছে। এতে দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। একদিকে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন জাত আবিষ্কার করেছে একই সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা ও ভর্তুকির মাধ্যমে তা কৃষক পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে ফলে কৃষি সেক্টরের সকল দিকে ঈর্ষণীয় সাফল্য আমরা পেয়েছি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিদেশে রফতানি করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরো সমৃদ্ধ করা সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর