এবছর অপেক্ষাকৃত কম ধরা পড়ছে?

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশে সাধারণত বর্ষাকালকে ইলিশের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এ সময়েই সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে এবং বাজারে বেশ ভাল পরিমাণে পাওয়া যায়। সে হিসেবে চলতি বছরে বর্ষাকাল পেরিয়ে এখন শরৎ চলছে। এই সময়ে বাজারে যে পরিমাণ ইলিশ থাকার কথা সেটি দেখা যাচ্ছে না। সেই সাথে যারা ইলিশ ধরার সাথে যুক্ত তারাও বলছেন যে, সাগরে ইলিশ তেমন ধরা পড়ছে না। যার কারণে হতাশ জেলেরা।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় ইলিশ মাছ ধরতে গিয়ে ফিরে আসা জেলেরাও অভিযোগ করেছেন যে, এ বছর জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না।

সীতাকুণ্ড উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমদ জানান, গত বছর এই সময়ে সীতাকুণ্ড উপকূলে মোট ইলিশ ধরা পড়েছিল ৪৭১.৫ মেট্রিক টন। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত সেখানে ইলিশ ধরা পড়েছে মাত্র দেড়শ মেট্রিক টনের মতো।

তিনি আরও জানান, তারা জেলার জেলে এবং অন্য মৎস্যজীবীদের সাথে কথা বলেও সম্প্রতি ইলিশ মাছ ধরা না পড়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোর মত ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ডিম ছাড়ার মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধসহ অন্যান্য উদ্যোগ যথাযথভাবে এই বছরও নেয়া হয়েছে।

এ অবস্থায় সবার মনেই প্রশ্ন উঠেছে- মাছ ধরা না পড়ার কারণ কী? বিষয়টি নিয়ে মৎস্য কর্মকর্তা আহমদ জানান, জেলেরা যারা মাছ ধরতে গিয়েছিলেন তারা বলছেন যে, এই বছর নদী থেকে সাগরে যে স্বাদু পানি প্রবেশ করে সেটির পরিমাণ কম। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার যে ফ্লো-টা, সেটা আগের মতো নেই। যার কারণে মাছ সাগর থেকে মিঠা পানিতে বা নদীতে কম প্রবেশ করছে। মাছ কম ধরা পড়ার এটি একটি কারণ। এছাড়া পূর্ণিমার সময় যখন জোয়ার বেশি থাকে তখন ইলিশ মাছ বেশি ধরা পড়ে। তবে সম্প্রতি জোয়ারের সময়ও পানির উচ্চতা গত বছরের মতো বাড়ছে না। জোয়ার আসলে পানির উচ্চতাটা যেমন উঠতো সেটা হচ্ছে না, আড়াই-তিন ফুট কম থাকছে। এটিও ইলিশ মাছ কম ধরা পড়ার কারণ।

এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনও ইলিশ মাছ কম ধরা পড়ার পেছনে কিছুটা দায়ী হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান। তবে এটি এখনো নিশ্চিত নয় বলেও জানান তিনি।

এ নিয়ে আনিসুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের চলাচল পথ এবং জীবনচক্রে অল্প-স্বল্প প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও সেটি এরই মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেছে সেটি বলা যাবে না। পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সে অনুযায়ী এই পথ পরিবর্তন হবে না সেটিরও আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশে পানি দূষণ এবং নদীতে নাব্যতার সংকটও রয়েছে। তবে এতো কিছুর মধ্যেও এখনো ইলিশের ‘মাইগ্রেশন রুট’ বা অভিবাসনের যে চলাচল পথ সেটি এখনো ট্র্যাকে আছে বলে জানান তিনি।

এদিকে জুন-জুলাই মাসে বর্ষকাল হলেও বাজারে ইলিশের উপস্থিতি কম দেখা যাওয়ায় অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, ইলিশের মৌসুম পরিবর্তন হয়েছে।

এ বিষয়ে ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, জুন-জুলাই মাসে ইলিশ কম ধরা পড়ে কারণ সেটি আসলে ইলিশের মৌসুম নয়। বরং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে যদি ইলিশ কম ধরা পড়ে তাহলে সেটি চিন্তার কারণ। সাধারণভাবে বর্ষাকাল ইলিশের মৌসুম বলে ধরা হয়। তবে বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে ইলিশ ধরা পড়বে বিষয়টি তা নয়।

তিনি বলেন, বৃষ্টিপাত শুরু হলে ইলিশ চলাচল শুরু করে তাদের অভিবাসনের চলাচল পথ ধরে। সেসময় তারা নদী ও সাগরের মোহনা হয়ে প্রজনন ও খাবারের জন্য নদীতে চলে আসে। ইলিশের ডিম ছাড়ার সময়, ডিমের আকার, পরিপুষ্ট ও বড় অবস্থায় ইলিশ চলাচল বাড়ে। এই সময়টা আসলে অগাস্ট থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসই প্রধান সময় ধরা হয়। অক্টোবরের পূর্ণিমাতে সবচেয়ে বেশি ইলিশ সাগর থেকে নদীতে চলে আসে ডিম ছাড়ার জন্য। আর এজন্যই এই সময়ে ২২দিন ডিম ছাড়ার সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে এর আগে-পরেও অনেক ইলিশ ধরা পড়ে। এটাই তাদের মূল মৌসুম।

তিনি জানান, মধ্য আশ্বিন মাস থেকে মধ্য কার্তিক বা অক্টোবর মাস- এই সময়টাই ইলিশ আসার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এটি নিয়ে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নাই।

সীতাকুণ্ড উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমদ বলেন, বর্ষাকাল চলে গেলেও এবছর আরো বেশি পরিমাণ ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা এখনো আছে।

তিনি জানান, গত বছর শুধু সেপ্টেম্বরেই একক মাস হিসেবে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়েছিল। সে হিসেবে এখনো সেপ্টেম্বর শুরু হয়নি। এবছরই এই মাসে ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

এছাড়া সামনে কয়েক মাসে ইলিশ ধরার বেশ কয়েকটি ‘জো’ রয়েছে। এই সময়গুলোতেও প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরার আশা করা হচ্ছে। তবে এটি যেহেতু প্রাকৃতিক বিষয় তাই সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ‘জো’ বলতে এমন একটি সময়কে বোঝায় যখন সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। সাধারণত অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময়ে যে জোয়ার হয় সেই সময়টিকেই ‘জো’ বলা হয়। প্রতি ১৫ দিনে একটি ‘জো’ ধরা হয়।

একই ধরণের মত দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমানও। তিনি বলছেন যে, বর্তমানে যে ইলিশ কম ধরা পড়ছে এটি নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই। অগাস্ট থেকে ইলিশ ধরা একটু করে শুরু হয়, সেটা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।

তিনি মনে করেন, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে দুটি অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা থাকবে। সেই সময়টাতে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে। এতে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। আগের বছর ৫১ শতাংশের বেশি ইলিশ ডিম ছেড়েছে। সেগুলো এখন বড় হয়ে নদীতে আসবে।

 

সূত্র : বিবিসি বাংলা

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর