স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতায় বাড়ছে করোনা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কক্সবাজারে হঠাৎ করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গেল পক্ষকালে সনাক্তের হার বাড়ায় বেড়েছে আতঙ্ক। ফেব্রুয়ারি হতে ১৭ মার্চ পর্যন্ত পরীক্ষার আওতায় আসাদের মাঝে প্রায় ৬ শতাংশ রোগী সনাক্ত হয়েছে। কক্সবাজার সৈকত ও আশপাশের পর্যটন স্পটে বেড়াতে আসা লোকজন এবং স্থানীয়দের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানায় উদাসীনতার কারণে হঠাৎ করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিমত জেলা সিভিল সার্জনের। এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, গত সপ্তাহে সারাদেশের মত কক্সবাজারেও করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এটা ক্রম ঊর্ধ্বমুখী। পরিসংখ্যান মতে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত গড়ে ৩০০ এর অধিক পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০ মার্চে ৪৫৭ জনে ৯ জন, ১২ মার্চে ৩৪৩ জনে ১০ জন, ১৩ মার্চে ৩৩৭ জনে ১৪ জন, ১৪ মার্চে ৩৯৫ জনে ১৬ জন, ১৫ মার্চে ৩৭২ জনে ১১ জন, ১৬ মার্চ ৪৬৮ জনে ৪ জন এবং ১৭ মার্চ ৩৫৪ জনে ৯ জন করোনা সনাক্ত রোগী পাওয়া গেছে। সারাদেশের মত কক্সবাজারেও পরিস্থিতি কঠিনের দিকে যাচ্ছে। তাই সকলের সচেতন হওয়া দরকার।

সিভিল সার্জন আরও জানান, গতবছর করোনার শুরু হতে চলতি মাসের ১৭ মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারে করোনা নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে প্রায় ৯৮ হাজার। সেখানে আক্রান্তের হার ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সুস্থতার হার ৯২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। মোট করোনা রোগী ৬ হাজার ১২৪ জন এবং এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৮২ জন। এরমধ্যে স্থানীয় ৭৩ জন এবং বাকি ৯জন রোহিঙ্গা। এখনো ৭ শতাংশ করোনা রোগী সুস্থ হয়নি।

করোনার টিকাদান বিষয়ে সিভিল সার্জন বলেন, কক্সবাজারে করোনার টিকা এসেছে ৮৭ হাজার ২২৮টি, প্রয়োগ করা হয়েছে ৬৭ হাজার ৭৫৭ জনকে। ৯ কেন্দ্রে ২৬টি বুথে এ টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

দেখা গেছে, কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক ও স্থানীয় মিলে প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক মানুষের আগমন হচ্ছে। ছুটির দিন শুক্র-শনিবারে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কারোই মুখে মাস্ক থাকে না। সামাজিক দূরত্বের বদলে গা ঘেঁষে একই স্থানে ভিড় করছেন হাজার-হাজার ভ্রমণ পিপাসু। পর্যটন স্পট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ কোথাও স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বেরও বালাই নেই। মাস্ক ছাড়া সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটকরা মাস্ক না পড়ার পক্ষে নানান ওজুহাত দেখাচ্ছে।

গাজীপুর থেকে স্বপরিবারে বেড়াতে আসা ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, মাস্ক পরা জরুরী, তবে ভ্রমণের সময় মাক্স পরলে উপভোগ করা যায় না।

ঢাকার লালমাটিয়া থেকে আসা সাদিয়া আফরিন বলেন, মেয়েদের জন্য মাস্ক বিব্রতকর। মাস্ক পরলে নাক-মুখ ঘেমে মেকআপ নষ্ট হয়। করোনা থেকে বাঁচতে মাস্ক ছাড়া অন্যসব বিধি মেনে চলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সৈকতে বিপদাপন্ন পর্যটক সেবায় থাকা সী সেইফ লাইফ গার্ডের সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান বলেন, করোনা প্রতিরোধে মাস্ক পরা ও নিরাপদ দূরত্ব পালনে সৈকতের প্রতিটি পয়েন্টেই জেলা প্রশাসনের পক্ষে মাইকে প্রচারণা চলে। কিন্তু সিংহভাগ পর্যটক মাস্ক পরেন না, নিরাপদ দূরত্বও বজায় রাখেন না। উল্টো জরিমানার ভয়ে মুখে দিয়ে নামা মাস্কগুলো সৈকতে ফেলে চলে যান। প্রতিদিন সকালে অনেক মাস্ক কুঁড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে হয় আমাদের।

করোনা বৃদ্ধিতে করণীয় নির্ধারণে ‘কোভিট-১৯ প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটি’ একসভা গত মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) জেলা প্রশাসনের শহীদ এটিএম জাফর আলম সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্বাস্থ্য বিভাগ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যাপ্তিবর্গ করোনা বৃদ্ধিতে কক্সবাজারবাসীর জন্য সর্তকতা এবং করনীয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১২টি পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে।

পদক্ষেপ সমূহ হলো, মাস্ক পরিধান নিশ্চিতকরণ, সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সচেতনতার বিষয়ে প্রচারণা, পর্যটন এলাকায় নিয়মিত অভিযান, হোটেল-মোটেল জোনে মাস্ক পরিধান ও স্যানিটাইজেশন নিশ্চিতকরণে মালিকদের সাথে সচেতনতামূলক সমাবেশ, হাসপাতাল সমূহকে প্রস্তুত রাখা, সরকারি লজিস্টিক সাপোর্ট প্রস্তুত রাখা, পর্যটকদের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ টিম গঠন, সরকারি হাসপাতালের সাথে প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় সমন্বয়, হোস্ট কমিউনিটিকে সজাগ করতে স্থানীয় মিডিয়াতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রচার এবং স্বাস্থ্য বিভাগকে কার্যকর করতে দ্রুত কমিটি গঠনসহ নানাবিধ পরিকল্পনা।

এরপর থেকে সংক্রমণের হার রোধকল্পে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি পালনে জনগণকে সচেতন করতে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন সচেতনতামূলক অভিযান পরিচালনা করছে। বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাদিয়া সুলতানার নেতৃত্বে শহরের গুমগাছতলা, বাজারঘাটা, গোলদিঘির পাড়, সদর থানা রোড, ডলফিন মোড়সহ সৈতকের বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চলে। এ সময় পথচারীদের মাস্ক বিতরণ করে মাস্ক পরিধানে উৎসাহ দানের পাশাপাশি ৮টি মামলায় অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক, ট্রপিক্যাল মেডিসিন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও করোনা প্রতিরোধ সেলের চিকিৎসক মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির চলমান করোনা রোগী বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, কক্সবাজার পর্যটন নগরী। মাঝখানে করোনার প্রাদুর্ভাব কম থাকায় পর্যটন মৌসুমে লোকসমাগম বাড়ছে। এটি এখনো বিদ্যমান। তবে, বেড়াতে আসাদের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। জনসমাগম বৃদ্ধি, টিকা গ্রহণের পর করোনা আর হবে না এমন মন মানসিকতায় জনসমাগম বৃদ্ধি করোনার জন্য দায়ী।

তার মতে, জেলায় রোহিঙ্গাসহ ৩৫ লাখ মানুষের বসবাস। এ পর্যন্ত ৭০ হাজার মানুষ টিকা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। গত বছর মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত টানা তিন মাস করোনা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে। এবারও একই সময়ের মধ্যে করোনার প্রকোপ বাড়তে পারে বলে মনে হচ্ছে। ভ্যাকসিন করোনা প্রতিরোধে কাজ করছে ৭৫ শতাংশ। দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে টিকা কাজ করছে না। কিন্তু একটি মাস্ক ৯৫ শতাংশ করোনা প্রতিরোধে সক্ষম, যদি অন্যান্য নির্দেশনা মেনে চলা হয়।

দুই শতাধিক করোনা রোগীকে স্বেচ্ছায় সেবা দেওয়া বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সন্দেহজনক করোনা রোগীর ফোন কল বেড়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে আবারোও করোনার ধাক্কা আসছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, পর্যটক ও স্থানীয়দের করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সর্বদা সচেতনতামূলক প্রচার ও প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। তা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর