ঠাকুরগাঁওয়ে ডানা মেলছে গরিবের স্বপ্ন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সারাজীবন কাঁচা মাটি আগুনত পুড়ি হাঁড়ি-পাতিল বানাইছু, কিন্তু স্বপনেতও ভাবো নাই-কাঁচা মাটি পুড়ি ইট বানেয়া পাকা বাড়িত থাকি বা পারিমো। দুইটা বেটিক বিহা (বিয়ে) দিবার পর আর সহায়-সম্বলও নাই। সেইতানে চিন্তা করা তো দূরের কথা এই বুড়া বয়সোত আসি পাকা বাড়িত শুতিবা পারিমো, সেইটা স্বপনেতও ভাবি নাই। কিন্তু সরকার এখন হামাক পাকা বাড়ি করি দিছে। এখন মনে হচে জীবনটা স্বার্থক।’ 

চোখে-মুখে অন্যরকম এক উচ্ছ্বাস নিয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে এমনই কথা জানাচ্ছিলেন, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের ৬৮ বছর বয়স্ক অভাবী মৃৎশিল্পী যগেন চন্দ্র পাল।

অভাবের সংসারে তার সন্তান বলতেই দুই মেয়ে। সহায়-সম্বল বিক্রি করে দুই মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর এখন স্ত্রী নিয়ে থাকেন অন্যের জায়গায় ঝুপড়িঘর বানিয়ে। সারাজীবন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে এখন বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন। দু-মুঠো আহার জোগাতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। এই শেষ জীবনে বাড়ি বানানোর কথা কখনই ভাবতে পারেননি তিনি।

তাও আবার পাকা বাড়ি। এতসবের মধ্যে শেষ জীবনে সরকারের দেয়া পাকা বাড়িতে ঠাঁই পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত তিনি। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বদ্বেশ্বরী তলা ‘সোনালী স্বপ্নালয়ে’ তিনি পেয়েছেন একটি পাকা বাড়ি।

একই পল্লীতে পাকা বাড়ি পাওয়া আক্তার বানু জানান, কুড়ি বছর আগে দিনমজুর শফিকুল ইসলামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্বামীর জমি না থাকায় তার কুড়িটি বছর কাটে মানুষের পুকুরপাড়ে ঝুপড়ি বানিয়ে। তাও আবার মাঝে মাঝে জোরে বাতাস হলে সব উড়িয়ে নিয়ে যায়। স্বামীর যা রোজগার তা পেট শান্ত করতেই চলে যায়।

স্থায়ী ঠিকানার কথা ভাবতেই পারেননি। নিজের বাড়ি হবে, তাও আবার পাকা বাড়ি-এটি স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের দেয়া এমন পাকা বাড়িতে ঠাঁই মিলবে, এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেই দুই চোখে দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

অতীতের দুর্বিষহ জীবন আর বর্তমানের এসব কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে আনন্দের কান্নায় হু হু করে কেঁদে উঠেন তিনি।

ঠাকুরগাঁও জেলার ৫ উপজেলায় ৭৮৯টি ঘরের নির্মাণ এখন শেষ পর্যায়ে। সদর উপজেলায় নির্মিত হচ্ছে ৩৩৩টি ঘর, পীরগঞ্জ উপজেলায় ৮৫টি, রানীশংকৈল উপজেলায় ৭০টি, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় ৬৫টি এবং হরিপুর উপজেলায় ২৩৬টি।

আগামী ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একযোগে সারাদেশে ন্যায় জেলার ৭৯০টি ঘর হস্তান্তর করবেন গৃহহীনদের মাঝে।

পারভীন বেগম, আব্দুল জলিলসহ বেশ কয়েকজন সুবিধাভোগীরা জানান, আমরা এতদিন কেউ অন্যের জমিতে কেউ হাটের জমিতে বসবাস করতাম। জমি কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে বাড়িঘর তৈরি করতে পারিনি। দিনমজুরি করে যা আয় হয় তা দিয়ে এমন পাকা ঘর নির্মাণ করা কখনো সম্ভবপর ছিলো না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের এমন পাকা ঘর দিয়ে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করেছে।

সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউপি চেয়ারম্যান সীমান্ত কুমার বর্মণ নির্মল জানান, যেসব ভূমিহীনকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে তারা কোনদিন এমন ঘর নির্মাণ করতে পারতেন না। সরকার তাদের পাকা ঘর নির্মাণ করে দেয়ায় পুনর্বাসিত পরিবারগুলো সরকারের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সদর উপজেলায় ৩৩৩টি ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ডিজাইন অনুযায়ী সবগুলো ঘর নির্মিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক মহোদয় প্রথম থেকে কাজের মান তদারকি করে আসছেন। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সহযোগিতায় সুবিধাভোগী নির্বাচন করা হয়েছে এবং প্রত্যেক পরিবারকে ২ শতক জমি এবং তার উপর নির্মিত ঘরের চাবি শিগগির হস্তান্তর করা হবে।

 লা প্রশাসক ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের গৃহ প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই অংশ হিসেবে ঠাকুরগাঁও জেলার ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষদের সনাক্ত করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রায় ৭ হাজার ৮শ জন গৃহহীন রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে এ জেলায় ৭৯০ জনকে পুনর্বাসনে গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।

আগামী ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ঘর হস্তান্তর করবেন আনুষ্ঠানিকভাবে। ঠাকুরগাঁওয়ে যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোও একইদিন উপকার ভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করা হবে। উদ্বোধনের পরপরই ভূমির দলিলপত্র কবুলিয়ত ও নামজারি ফরমসহ সমস্ত কিছু হস্তান্তর করা হবে এবং তারা বসবাসের পূর্ণ অধিকার পেয়ে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর