হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা। বছরব্যাপী বরগুনার এই তিন নদীতে চলে জেলেদের ইলিশ শিকার। বরগুনা জেলার বাসিন্দাদের বড় একটি অংশেরই জীবন-জীবিকা চলে এই তিন নদীর ইলিশে।
নদীকেন্দ্রিক জনপদ হওয়ায় জেলাটি স্বভাবতই জেলে অধ্যুষিত। বিশেষ করে নদী তীরবর্তি এলাকার মানুষ যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমিক জেলে পেশাকেই ধরে রেখেছেন। নদী ও সাগরে মাছ শিকার করেই চলে এদের জীবন ও জীবিকা।
স্থানীয় মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুসারে বরিশাল বিভাগ এখন দেশের মোট ইলিশের প্রায় ৬৬ ভাগের জোগানদাতা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল অঞ্চল থেকে আহরণ করা হয় ৩ লাখ ৩২ হাজার ২৫ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে ভোলা ও বরগুনা ইলিশের প্রধান উৎস। এই দুই এলাকার বাসিন্দাদের ধারণা, বিষখালী-বলেশ্বর ও পায়রা তিনটি নদীতেই সবচেয়ে বেশি ইলিশের বাস।
চাঁদপুরকে ইলিশের জেলা বলা হলেও পরিসংখ্যানে বরগুনা চাঁদপুরের চেয়ে ইলিশ আহরণে কয়েকধাপ এগিয়ে। গত বছরের ২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ইলিশ উৎসবে আয়োজকরা দাবি করেন যে বরগুনা জেলার ৬টি উপজেলায় প্রায় এক লাখ মৎস্যজীবী রয়েছেন, এদের মধ্যে প্রান্তিক জেলের সংখ্যা ৬০ হাজার। এছাড়াও রয়েছেন সুন্দরবন ও আশপাশের নদী খাল ও গভীর সমুদ্রগামী জেলে। এসব কারণে বরগুনাই “ইলিশের জেলা” হওয়ার দাবিদার।
ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের প্রায় ৮৫% উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী ও সাগর থেকে প্রায় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই জেলায় এক লাখ মেট্রিক টনের মতো ইলিশ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বরগুনার বিষখালী, পায়রা ও বলেশ্বর থেকে আহরণ করা হয় ৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। সাগর থেকে ৯১,০০০ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরগুনা জেলা থেকে আহরিত ইলিশের মোট পরিমাণ হচ্ছে ৯৫ হাজার ৯৩৮ মেট্রিকটন। অন্যদিকে, একই অর্থবছরে চাঁদপুর থেকে ইলিশ ধরা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার মেট্রিক টন। ইলিশ আহরণে এই জেলার অবস্থান ষষ্ঠ স্থানে। অথচ এই চাঁদপুর ‘ইলিশের বাড়ি’ বলে পরিচিত। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা। মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বরগুনার তিন নদীর ইলিশই সুস্বাদু। নদী তিনটির মধ্যে কেবল বিষখালীতে অল্প উজানে এলেই মিষ্টি পানি। দিনে ও রাতে দুই বেলা জোয়ারের প্রবাহ বেশি বলে এই নদীর পানিও স্বচ্ছ। কিন্তু পায়রা ও বলেশ্বরের মিঠাপানি আরও অনেক বেশি উজানে। তা ছাড়া যে নদীর পানি যত স্বচ্ছ, সে নদীর ইলিশের পিঠের দিকও তত কালচে ও পুরু। নদীর পানি ঘোলা হলে ইলিশের পিঠের কালচে রং গাঢ় হয় না। যেসব ইলিশের পিঠের রং কালচে, সেগুলোর স্বাদও বেশি। এ জন্যই বিষখালীর ইলিশ পরিপুষ্ট, উজ্জ্বল ও বেশি স্বাদযুক্ত বলে মনে করা হয়।
বরগুনার নদী থেকে আহরিত ইলিশের স্বাদ পদ্মার ইলিশের চাইতে অনেক সুস্বাদু বলেও দাবি করেন স্থানীয় ইলিশ গবেষক এম জসীম উদ্দিন। ইলিশ নিয়ে গবেষণামূলক একাধিক প্রতিবেদন করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, বরগুনার ইলিশ অন্য যেকোনো জেলার ইলিশের চাইতে সুস্বাদু। আর এই জেলার ইলিশ সাইজেও বড় থাকে। উৎপাদন, স্বাদ, গড়ন সবদিক থেকে এগিয়ে তিন নদীর ইলিশ।
ইলিশ গবেষক ও মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের ইকো-ফিশ প্রকল্পের দলনেতা আবদুল ওহাব বলেন, বিষখালীর ইলিশের সুখ্যাতি আছে। ইলিশের দুটি ভান্ডার বঙ্গোপসাগর ও পদ্মা-মেঘনার ইলিশ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। বিষখালীর ইলিশ নিয়ে গবেষণা হলে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্যের ইলিশের ভান্ডারের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বর এই তিন নদীতে তিনটি পৃথক ইলিশের অভয়াশ্রম করার প্রস্তাব দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকোফিশ প্রকল্প-২ এর গবেষকরা।
তারা জানান, এরই মধ্যে তিনটি নদীর পানির গুণাগুণ ও কী ধরনের খাবার রয়েছে, তা পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইলিশের জীবনচক্র ও স্বাদের কারণও অনুসন্ধান করবেন তারা। এ জন্য এসব নদ–নদীর পানি, মাছের খাদ্যকণা প্ল্যাঙ্কটন (পানিতে ভাসমান ক্ষুদ্র জীব) ও ইলিশের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের একজন এবং পানি, খাদ্যকণার গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে যুক্ত করা হচ্ছে। পুরো গবেষণাকর্মের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইকোফিশ প্রকল্পের দলনেতা ও মৎস্য বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল ওহাব।