হাওর বার্তা ডেস্কঃ একটা সময় ছিল মানুষের বিনোদনের মাধ্যম ছিল কেবল টেলিভিশন। কিন্তু অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন ও ভালো বিষয়বস্তুর অভাবে সেখান থেকে মানুষ ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সামনে চলে আসে অনলাইন। ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম (ইউটিউব, ফেসবুক ভিডিও) ইত্যাদি দর্শকের বিনোদনের অভাব ঘুচিয়ে দেয়। বোকা বাক্স থেকে বিনোদন চলে যায় মানুষের হাতের মুঠোয়—সেলফোনে কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিনে। আড্ডা সঞ্চালক প্রথমেই বলছিলেন, কোনো গুরুগম্ভীর ভারী ভারী কথা হবে না। আড্ডা চললও মুচমুচে পরিবেশে। সঙ্গে থাকল হাসি-ঠাট্টা। চলল চা-কফি। নির্মাতারা অনলাইন বাজার নিয়েই শুরু করলেন।
অনলাইন মানেই হলো মুক্তবিশ্ব। টিভিতে নিজেদের চ্যানেলে নিজেদের নাটক-টেলিছবি দেখার সুযোগ মেলে। কিন্তু অনলাইনটা বৈশ্বিক। নির্মাতা তাঁর নির্মাণ যেকোনো দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। দর্শকও স্বাধীনভাবে যেকোনো জায়গা থেকে তা দেখতে পারে। বেশ কিছু আলোচিত মিউজিক ভিডিও ও নাট্যনির্মাতা তানিম রহমানের ভাষায়, ‘আমার শুরুটা হয়েছিল বিজ্ঞাপন দিয়ে। তারপর টেলিভিশনে নির্মাণ। এখন অনলাইনের জন্যই কাজ করা হয় বেশি। এই মাধ্যমে বিশ্বায়নের সুযোগটা বেশি। কলকাতার লোকেরাও আমাদের কাজ এত ফলো করে, এটা ধারণায় ছিল না।’ নির্মাতা শাহরিয়ার পলকের কাছেও তাই। ‘ইচ্ছে মানুষ’সহ বেশ কিছু মিউজিক ভিডিওর সফল নির্মাতা বললেন, ‘ক্লাসে পড়েছি বিশ্বায়ন কী, আর অনলাইনের জন্য বানাতে এসে দেখলাম এর সত্যতা। দেশে বসেই একটা কিছু বানালাম। সেটা দেখা গেল উরুগুয়েতে বসে একজন দেখছে।’
চলুন এক পলকে দেখে নেওয়া যাক, কী ধরনের বিষয় দিয়ে সাজানো হয়েছে এই সময়ের অনলাইনের জায়গা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অনলাইনে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখার সেরা মাধ্যম ইউটিউব। বিভিন্ন চ্যানেলে নানা ধরনের বিষয়ের ভিডিও দেখার সুযোগ মেলে। এ তালিকায় আছে, ওয়েব সিরিজ, মিউজিক ভিডিও, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ইউটিউব ছাড়া কিছু ওয়েব স্ট্রিমিং সাইট আছে, বায়োস্কোপ, বাংলাফ্লিক্স, আইফ্লিক্স, পপকর্ন, বঙ্গ বিডি ইত্যাদি। এসব সাইটেও নানা ধরনের আয়োজন দেখার সুযোগ মেলে। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে অনলাইনের জন্য আলাদা প্রযোজকও।
আড্ডার নির্মাতারা তরুণ। কাজও করতে চান তারুণ্য নিয়ে। অন্যদিকে এই মাধ্যমের দর্শকেরাও বেশির ভাগ তরুণ। তারুণ্যদীপ্ত এই মাধ্যমে কাজ করতে ভালো লাগে নির্মাতা তানিম রহমানের। বললেন, ‘আমাদের নির্মাণগুলো আসলে তরুণেরা বেশি দেখে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সমসাময়িক থাকতে চাই। আমি এখন যেভাবে মানুষকে বিনোদন দিতে পারছি, ১০ বছর পরে এভাবেই দিতে চাই। এর জন্য অনলাইনের থেকে ভালো জায়গা আর নাই।’
অন্যদিকে অনলাইনে বিশেষ করে ইউটিউব ভিডিওতে লাইক, ডিজলাইক ও মন্তব্য করা যায়। বেশি ভালো লাগলে করা যায় শেয়ারও। বেশি শেয়ার হলে নাম হয়ে যায় ‘ভাইরাল’। নির্মাতা ভিকি জাহেদ বলেন, একটা ভিডিওর লাইক শেয়ার দিয়ে বোঝা যায় দর্শকেরা কীভাবে নিয়েছেন। আবার ডিজলাইক ও খারাপ মন্তব্য দেখেও নির্মাতা শিখতে পারেন পরবর্তী ভিডিওতে কী করা উচিত।
সৃজনশীল কাজের সঙ্গে স্বাধীনতা একটা বড় ব্যাপার। কালী ওয়েব সিরিজ নির্মাতা অমিত আশরাফ মনে করেন অনলাইনে অন্য মাধ্যমের থেকে পরিচালকের সৃজনশীল কাজ করার বেশি স্বাধীনতা থাকে। অ্যাডমিশন টেস্ট নামে একটি ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করে আলোচনায় আসা নির্মাতা তপু খানও সে কথায় সায় দিলেন। প্রজন্ম টকিজের বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্মাতা সালেহ সোবহান বললেন, ‘টেলিভিশনে সব কাজ করা যায় না। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। দেখা যায়, যে বিষয় নিয়ে আমরা গল্প বলতে চাই, সেটি টেলিভিশনের অনেক নিয়মকানুনের জন্য আটকে যায়। অনলাইনে এই সমস্যাটা নেই। যেকোনো বিষয় নিয়ে পরিচালক সৃজনশীলভাবে গল্পটি বলার সুযোগ পান।’
অবশ্য সে ক্ষেত্রে একেবারে যে সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে গল্প বলা হয় এমনটা নয়, মনে করেন তানিম রহমান। কারণ, অনলাইনে ভিউ বাড়ানোর জন্য যৌন আবেদনময়ী চটকদার গল্পও বানানো হয়। সেসব করে টিকে থাকা যায় না। অন্যদিকে কাজের ক্ষেত্রেও এসেছে বৈচিত্র্য। টেলিভিশনে শুধু নাটক আর টেলিফিল্ম দেখেই দর্শকের সার। অনলাইনে এসেছে নতুন ধারা। যেমন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। নির্মাতা ভিকি জাহেদের পরিচিতিটাই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মাতা দিয়ে। মায়া, মোমেন্টস, অক্ষর দিয়ে তিনি উঠতি নির্মাতা। বললেন, ‘একটা সময় ছিল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ধারণাটা কারও কাছে পরিষ্কার ছিল না। বাজেটও পাওয়া যেত না। এখন অনলাইনের অন্যতম বিষয় স্বল্পদৈর্ঘ্য। বিভিন্ন দিবস ও বিশেষ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে হরহামেশা। অনলাইনের আরেক যুগান্তকারী বিষয় মিউজিক ভিডিও। পলক শাহরিয়ার ও তানিম রহমানের নামের সঙ্গে মিউজিক ভিডিও শব্দটি একসঙ্গে বাধা। ‘লোকাল বাস’ কিংবা ‘ঝুম’। তানিমের জন্য এইটুকু বলাই যথেষ্ট। আর পলক তো ‘ইচ্ছে মানুষ’ দিয়ে বাজিমাত। দুজনের মতে, গান শোনার থেকে মানুষ এখন দেখে বেশি। এদিকে তপু খানের কাছে অনলাইনের সুবিধা বাজেট। তাঁর মতে, টেলিভিশনে একটা নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যে কাজ করতে হয়। অনলাইনে এমনটি নেই। গল্প বলার ধরনের ওপর বাজেট তৈরি হয়। তপু ওয়েব সিরিজ অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে নিজেকে চিনিয়েছেন।
অনলাইনের নির্মাণের জায়গাটি এখন কেবল চারাগাছের মতো। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে। নতুন এই প্ল্যাটফর্ম যেমন দর্শকের কাছে নতুন স্বাদ, তেমনি নির্মাতাদের কাছেও। এখনো ঠিকঠাক ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে উঠতে পারেনি। তবে হচ্ছে। তানিম রহমানের ভাষায়, এই ইন্ডাস্ট্রি এখনো ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি। অনলাইন ব্যবসাটা সবাই মাত্র বোঝার চেষ্টায় আছে। যাকে বলে ‘অনগোয়িং প্রসেস’।
কিছু অপ্রিয় কথা
নির্মাতাদের কথায় যে কেবল অনলাইনের ভালো দিক উঠে এল এমনটি নয়। আছে কিছু অপ্রিয় কথাও। ভিডিও বুস্ট করে কৃত্রিমভাবে ভিউ বাড়ানো তার মধ্যে একটি। যেটি অনেক সময় দর্শককে ভালো কনটেন্ট বাছাই করতে ধাঁধায় ফেলে দেয়। নির্মাতারা একমত, এটি ঘটে।
তবে দর্শকেরা অনেক বুদ্ধিমান। তাদের কাছে ভিউয়ের থেকে কনটেন্ট ভালো কি খারাপ সেটিই বড়। নির্মাতাদের কাছে বুস্টের মূল কাজ মানুষের কাছে পৌঁছানো। কৃত্রিমভাবে ভিউ বাড়ানো নয়। অন্যদিকে টেলিভিশনে যেমন রিভিউ কমিটি থাকে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এখনো তেমনটি নেই। যে যার মতো বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। তা ছাড়া অনেক সুযোগ-সুবিধাও মিলছে না। কপিরাইট নিয়ে নিত্যনতুন ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। নির্মাতাদের মতে, বুস্ট অনেকটা দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে জানিয়ে দেওয়ার মতো। সাড়া দেওয়ার ব্যাপার দর্শকদের।
আচমকা একটা প্রশ্ন তোলা হয়। তবে টিভি কি হারিয়ে যাবে? নির্মাতারা ভাবলেন। কিছু পরে সালেহ সোবহান মুখ খুললেন, ‘আমার মনে হয় না। অনলাইন পুরোপুরি আলাদা মাধ্যম। কনটেন্টও আলাদা। দুটোই থাকবে।’ তানিম রহমান বলেন, ‘টেলিভিশন যখন আসে তখন সিনেমা নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু এখনো সিনেমা হল আছে। সিনেমা চলছে। টেলিভিশনও থাকবে।