শ্রমবাজারে নতুন হাওয়া

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের সবচেয়ে বড় উৎস প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ। কিন্তু  বৈশ্বিক মহামারি করোনায় শ্রমবাজারে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তবে দীর্ঘ স্থবিরতা কাটিয়ে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে শ্রমিকদের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে স্বস্তি ফিরতে শুরু করছে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কর্মরত শ্রমিকদের। নতুন করে মালয়েশিয়া, ইতালি ও গ্রিসে শ্রমিক নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করায় জনশক্তি রফতানির পালেও হাওয়া লেগেছে। দুই বছরের মহামারির ধাক্কা সামলে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাঙ্গা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি। এতে করে তাদের অভিবাসী কর্মীর চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই বাড়ছে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি। মধ্যপ্রাচ্যের সউদী আরবে সর্বোচ্চ জনশক্তি রফতানি হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মরিশাসে কর্মী গমনের সংখ্যা বাড়ছে। পূর্ব এশিয়ার জাপানেও শিক্ষানবিস কর্মী যাওয়া শুরু হয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সউদী ভ্রাতৃপ্রতিমসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করছে। সউদী নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী নিচ্ছে। গত ১ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৯১৪ জন নারী-পুরুষ কর্মী সউদী আরবে চাকরি লাভ করেছেন। একই সময়ে ওমানে ১৩ হাজার ৩১৩ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪ হাজার ৬০৩ জন, সিঙ্গাপুরে ৫ হাজার ১১৪ জন, মরিশাসে ৪১৪ জন, পোল্যান্ডে ১০৩ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪২৬ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য শিগগিরই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হতে যাচ্ছে। চলতি মাসেই দেশটিতে কর্মী যাওয়া শুরু হবে। এদিকে, ডলার সঙ্কটের মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। বিদায়ী অর্থবছর রেমিট্যান্স নিয়ে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসেই তা অনেকটাই কেটে গেছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রায় এক হাজার মালয়েশিয়াগামী কর্মীর নিয়োগানুমতি দিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রবাসী মন্ত্রী বলেন, উভয় দেশের চুক্তি অনুযায়ী বিএমইটির ডাটা ব্যাংক থেকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মী নিয়োগের কথা। কিন্তু এজেন্সিগুলো এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছে না। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ডাটা ব্যাংক থেকে কর্মী নেয়ার জন্য বিএমইটির ডিজি শহিদুল আলমের মাধ্যমে এজেন্সিগুলোকে চিঠি দেয়া হচ্ছে।

কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের কাউন্সেলর লেবার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত দেশটির প্রায় ৪শ’ কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য আবেদন জানিয়েছে। আমরা দ্রুত যাচাই বাছাই করে কর্মী নিয়োগের সত্যায়ন দিচ্ছি। তবে দালাল চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু হাজার হাজার কর্মী রাজধানীর সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল সেন্টারগুলোতে চড়া দামে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছে। এসব কর্মী আদৌ দেশটিতে যেতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

জনশক্তি রফতানি বাড়তে থাকায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও গতি ফিরেছে। গত জানুয়ারি মাসে ১৭০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ডিসেম্বরের তুলনায় ৮ কোটি ডলার বেশি। ডলার সঙ্কটের মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। বিদায়ী অর্থবছর রেমিট্যান্স নিয়ে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসেই তা অনেকটাই কেটে গেছে। সদ্য বিদায়ী জুলাই মাসে প্রবাসীরা দেশে প্রায় ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার বা ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৯ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এটি একক মাস হিসাবে গত ১৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং গত অর্থবছরের জুলাইয়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে দেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে বলে জানান বায়রা নেতৃবৃন্দ।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের জুলাই মাসে প্রবাসীরা ১৮৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের একই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অন্যদিকে, চলতি বছরের গত জুনে প্রবাসীরা ১৮৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ফলে গত জুন মাসের তুলনায় সদ্য শেষ হওয়া জুলাইয়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও আল রাবেতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আবুল বাশার কুয়ালালামপুর থেকে ইনকিলাবকে জানান, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের অনুমতির জন্য কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে নতুন নতুন ফাইল জমা হচ্ছে। বিএমইটির সূত্র জানায়, ২০২১ সালের প্রথম ৭ মাসে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ১৮৭ জন। আর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪২৬ জন। ২০২১ সালে পুরো বছরেই এই সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন। বিগত ডিসেম্বরে বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন। ২০২১ সালে মোট জনশক্তি রফতানির মধ্যে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জনই গেছেন সউদী আরবে। অর্থাৎ ৭৪ শতাংশই গেছেন সউদী আরবে। ২০২১ সালে ৮০ হাজার ১৪৩ নারী কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। নারী কর্মীদের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি সউদী আরবে গেছেন ৪৬ হাজার ৩৬১ জন। এরপর জর্ডানে ১১ হাজার ৬৯৭ জন, আর ওমানে গেছেন ৭ হাজার ৬৪৫ জন নারী কর্মী। চট্টগ্রাম থেকে জনশক্তি রফতানি হয়েছে দ্বিগুণ। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাইরে নতুন বাজার সৃষ্টির তাগিদ রয়েছে জনশক্তি রফতানিকারকদের। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম থেকে ২৪ হাজার ৬১৭ জন বিদেশে চাকরি লাভ করে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই চট্টগ্রাম থেকে বিদেশে চাকরি লাভের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার জনে।

বায়রার এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কর্মীদের যাওয়ার চাহিদাটা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আরো বেশি জনশক্তি রফতানি সম্ভব। দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য সরকার অতিসম্প্রতি সারাদেশে আরো ২৪টি টিটিসি উদ্বোধন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি এসব নতুন টিটিসি উদ্বোধন করেন।

নিউ এইজ ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী সওকত হোসেন সিকদার মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে অহেতুক বিলম্ব হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইনকিলাবকে বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৫০ জন কর্মী নিয়োগের অনুমতি দিলেও কর্মী বাছাইয়ের অনুমতি না দিয়ে সাড়ে ৪শ’ ডাটা ব্যাংকের কর্মীর তালিকা ধরিয়ে দিয়েছে। এতে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধরে রাখতে হলে সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে প্রক্রিয়ায় কর্মী যাচ্ছে একই প্রক্রিয়ায় দেশটিতে কর্মী প্রেরণের সুযোগ দিতে হবে। চলতি মাসেই মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের ফ্লাইট দিতে হবে। অন্যথায় দেশটির নিয়োগকর্তারা বিলম্বের কারণে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। তিনি বহির্বিশ্বের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং দেশের স্বার্থে অভিবাসী কর্মী প্রেরণের প্রক্রিয়া সহজীকরণের জোর দাবি জানান। ইয়াম্বু ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা জানান, জাপানের বিভিন্ন সেক্টরে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি কর্মীদের শুধু জাপানি ভাষা শিক্ষা দিতে পারলেই বিনা অভিবাসন ব্যয়ে দেশটিতে সর্বোচ্চ বেতনে চাকরি লাভের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। গত মে ও জুন মাসে ইয়াম্বু ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ৬ জন কর্মী টোকিওতে গেছে। এসব কর্মী বর্তমানে দেড় লাখ থেকে দু’লাখ টাকা বেতন পাচ্ছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর