চবি ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নকারী ৫ ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেফতার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় চিহ্নিত ছাত্রলীগের ছয় কর্মীর মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এরপরই এই ঘটনায় জড়িতদের আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দিয়েছেন ভিসি প্রফেসর ড. শিরীন আক্তার। গতকাল শনিবার ৩৪তম সিন্ডিকেট সভায় তিনি এই ঘোষণা দেন। এদিকে দোষী সবাইকে গ্রেফতার এবং কঠোর সাজা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সব অভিযুক্ত গ্রেফতার না করা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন তারা।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই ঘটনায় ছয়জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ঘটনার নেতৃত্বদাতা মো. আজিম চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আজিমের সঙ্গে গ্রেফতার বাকি তিনজন ছাত্রলীগের অন্য একটি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। তারা সবাই ক্যাম্পাসেই বসবাস করেন। আজিমের সঙ্গে গ্রেফতার বাকি চারজন হলেন- নুর হোসেন শাওন (২২), নুরুল আবছার বাবু (২২), মাসুদ রানা (২২) ও সাইফুল ইসলাম (২১)। আজিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ও নুরুল আবছার বাবু নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নুর হোসেন শাওন হাটহাজারী কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান প্রথম বর্ষ ও মাসুদ একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আজিমের বাবা আমির হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের কর্মচারী। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের স্টাফ কোয়ার্টারে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। বাকি তিনজনের বাবাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মচারী এবং ক্যাম্পাসে পরিবার নিয়ে থাকেন বলে জানিয়েছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। গ্রেফতার সাইফুল ইসলাম হাটহাজারী কলেজের ছাত্র বলে জানা যায়। একই ঘটনায় ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত মেহেদী হাসান হৃদয়কে (২৩) র‌্যাব হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে তাকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গ্রেফতার দেখানো হয়নি।

র‌্যাব চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা জানান, সাইফুল নামে আরও দু’জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব জানায়, ঘটনার শিকার ছাত্রী গত ১৭ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে তার বন্ধুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা হয়ে প্রীতিলতা হল সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রাত সোয়া ১০টার দিকে দু’টি মোটর সাইকেলে আসা পাঁচজন তাদের পথরোধ করে জেরা করতে থাকে। ওই ছাত্রীর বন্ধুকে অহেতুক মারধর করতে থাকে। ভুক্তভোগী বাধা দিলে তাকেও মারধর করা হয়। এসময় ছাত্রী ও তার বন্ধুর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে ছাত্রীর ব্যাগ ও দু’জনের মোবাইল কেড়ে নেয়। এছাড়া তাদের কাছ থেকে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা কেড়ে নেয়া হয়।

এরপর দু’জনকে টেনেহিঁচড়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা হলের পেছনে ইটের রাস্তা দিয়ে ঝোপের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আবারও মারধর করা হয় তাদের। একপর্যায়ে বন্ধুকে আটকে রেখে ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের পর বিবস্ত্র করে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে। আজিম নিজে তার মোবাইলে ভিডিও ধারণ করেছে।

গ্রেফতার বাবু ও শাওন ভিকটিম ও তার বন্ধুর দুটি মোবাইল কেড়ে নিয়ে একইসময় ভিডিও ধারণ করে। ভিডিও ধারণের পর আজিম হুমকি দেয় তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক না করলে ভিডিও ভাইরাল করে দেবে। ছাত্রী ও তার বন্ধু প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নির্যাতনকারীদের হাতে জিম্মি ছিলেন। মোবাইল তিনটি উদ্ধার করেছে র‌্যাব। যে দুটি মোটর সাইকেলে করে নিপীড়করা ঘটনাস্থলে এসেছিলেন এর একটি শাওনের এবং অন্যটি সাইফুলের। দুটি মোটর সাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শাওনের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-৭ এর হাটহাজারি ক্যাম্প কমান্ডার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান।

এদিকে, যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন ভিসি ড. শিরীণ আখতার। বার্ষিক সিনেট সভায় ৩১ নম্বর সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ওয়াশিকা আয়েশা খানের এক প্রশ্নের জবাবে এই কথা বলেন তিনি। শিরীণ আখতার বলেন, যেই ঘটনা ঘটেছে খুবই দুঃখজনক। ঘটনার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে। তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী খোঁজ-খবর নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি কমিটি আছে। তার মাধ্যমে আমরা আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেব।

ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনার পর বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্রীরা বের হয়ে ভিসির বাড়ির রাস্তায় সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। সেখানে তারা ৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো- ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টার নিরাপত্তা চাই, অকার্যকর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল বাতিল করে নতুন করে কার্যকর সেল গঠন করতে হবে, চার কার্যদিবসের মধ্যে আসামীদের বিচার করতে হবে, এর মধ্যে কোনো সমাধানে পৌছাতে না পারলে প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করতে হবে।

এর পরদিন শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে এই ৪ দফা দাবি আদায়ের জন্য প্রশাসনিক ভবনের সামনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষার্থীদের এই দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ১২ জন শিক্ষক। এরপর থেকে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলো একাধিক কর্মসূচি পালন করে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা এখনো আমাদের চার দফা দাবিতে অটল আছি। এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এর জন্য আমরা আনন্দিত। তবে এই ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করে কঠোর সাজা না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর