সিলেটে বন্যা: পুনর্গঠনই এখন বড় চ্যালেঞ্জ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সিলেট-সুনামগঞ্জের অধিকাংশ এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে বহু কষ্টে তৈরি বসতঘরটি এখন আর নেই, বন্যার পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। প্রশাসনের হিসেবে সিলেটের ২২ হাজার ৪৫০টি আর সুনামগঞ্জের অন্তত ১০ হাজার বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে গেছে পানির তোড়ে। এসব পরিবার এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। তাই বন্যা শেষ হলেও সর্বস্ব হারানো এসব মানুষ কবে নিজ ভিটায় উঠতে পারবেন, তা একেবারেই অনিশ্চিত।

সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, সিলেট-সুনামগঞ্জে সড়ক বিভাগের ৩৬০ কিলোমিটার সড়ক ভেঙে গেছে। পাশাপাশি এলজিইডির ৪ হাজার কিলোমিটার সড়ক ভেঙে গেছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে এসব সড়কের কঙ্কাল চেহারা বেড়িয়ে আসছে। ঐ সড়কগুলো দিয়ে এখন চলাচল করাই দায় হয়ে পড়েছে। দ্রুতই এগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। এমনকি পানিতে সিলেটের যে ৮৮ হাজার ৬২২ হেক্টর জমি ডুবে গিয়েছিল, সেগুলো চাষাবাদের জন্য প্রস্তুত করতেও দীর্ঘ সময় লাগবে। ফলে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সড়ক-বাড়িঘর পুনর্গঠন।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সড়ক, ঘরবাড়ি, ফসল, মাছের খামার, প্রাণিসম্পদসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ও ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শুধু সুনামগঞ্জেই সড়ক বিভাগ ও এলজিইডির ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়। এছাড়া সিলেটের আরো ২ হাজার ১৬০ কিলোমিটার সড়ক ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু সড়ক বিভাগের ক্ষতি হওয়া ১২৫ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারে প্রয়োজন হবে শত কোটি টাকা। বাকি এলজিইডির সড়ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তি পর্যায়ে গৃহস্থালি জিনিসসহ নানা ক্ষয়ক্ষতির হিসাব-নিকাশ সত্যিই এখন কঠিন। অবশ্য সড়ক ও ব্রিজ মেরামতে সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা মাঠে কাজ করছেন।

স্থানীয়রা বলেছেন, ত্রাণের পাশাপাশি এখন সব ক্ষেত্রে ব্যাপক পূনর্বাসন প্রয়োজন। আউশ ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আগে বোরোও গেছে। তাই কৃষক পড়েছেন বিপাকে। আমন ফসল না ওঠা পর্যন্ত বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ব্যাপক সবজি চাষ ও নানা জাতের ফসলের জন্য প্রণোদনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রিধান-৪৬সহ বিভিন্ন জাতের ধান ফলানোর সুযোগ রয়েছে। এসব জাতের ফসল পানির নিচে গেলেও ১৫-২১ দিন বাঁচে। এপ্রিল ও মে মাসের দুটি বন্যায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতির অঙ্ক যোগফল দিতে না দিতেই তৃতীয় বন্যাটি সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার ইতিহাস ভঙ্গ করেছে। ক্ষয়ক্ষতির অঙ্কের সঙ্গে কষ্টের গল্প বেড়েই চলছে। এবারের বন্যায় সিলেট বিভাগে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মোট ফসলি জমির ৪৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ পানিতে ডুবে গেছে। চলতি মৌসুমে আউশ, বোনা আমন ও সবজি মিলিয়ে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। এর মধ্যে পানিতে ডুবেছে ৮৮ হাজার ৬২২ হেক্টর জমি।

সিলেট অঞ্চলের কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মোশাররফ হোসেন খান বলেন, এই বিভাগে ৬৫ হাজার ৮০৭ হেক্টর জমির আউশ, ১৪ হাজার ৯৮৮ হেক্টর জমির বোনা আমন এবং ৭ হাজার ৮২৭ হেক্টর জমির সবজি পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় সর্বোচ্চ ২৬ হাজার ২৭৯ হেক্টর জমির আউশ ধান নিমজ্জিত রয়েছে। এ জেলায় ২ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমির সবজি পানিতে তলিয়ে আছে। এছাড়া, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় যথাক্রমে ১১ হাজার ৪০০ হেক্টর, ১৬ হাজার ৩৩৮ হেক্টর ও ১১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর জমির আউশ ধান পানিতে তলিয়ে আছে। এছাড়া, হবিগঞ্জের ১৪ হাজার ৬৩০ হেক্টর ও মৌলভীবাজারে ৩৫৮ হেক্টর জমির বোনা আমন পানিতে ডুবেছে। সুনামগঞ্জে ২ হাজার ৪০০, সিলেটে ২ হাজার ৬৬৫, হবিগঞ্জে ১ হাজার ৯১৫ ও মৌলভীবাজারে ৮৪৭ হেক্টর জমির সবজি এখন পানির নিচে ডুবে আছে।

এবার বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন সিলেট জেলার সোয়া ৪ লাখ পরিবারের প্রায় ২২ লাখ মানুষ। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকা, জেলার ১৩টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯৯ ইঊনিয়ন। ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন এবং ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, এখনো আমরা ত্রাণ বিতরণের কাজ করছি। পাশাপাশি বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজও চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাড়িঘর নির্মাণে সহায়তা দেওয়া হবে। জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ২ হাজার ৮৮৭টি গ্রামের মধ্যে প্রায় সবগুলো গ্রামের অবস্থা একই ধরনের। প্রাথমিক হিসাবে এবারের বন্যায় জেলার প্রায় ১৫ হাজার পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। ৩০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সব মিলিয়ে এখানে ১০ হাজারের মতো বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার কেজাউড়ার বাসিন্দা রঞ্জিত দাস জানান, এনজিওর ঋণ এবং কয়েক বছরের পরিশ্রমের আয় দিয়ে সামান্য কিছু জমি কিনে বসতঘর করেছিলেন, বন্যায় ঘরটির কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে আশ্রয় নেওয়া পশ্চিম সুলতানপুরের হাজেরা খাতুন বললেন, তার ঘর দেবে গেছে, ভেসে গেছে দরজা। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম বললেন, ত্রাণ বিতরণ শেষ হলে দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে। তখন বলা যাবে কতগুলো ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। অন্তত ১০ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি থাকার উপযোগী থাকবে না। যে বাড়িগুলো নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।

এদিকে সিলেটের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বন্যায় সিলেটে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় ১২৫ কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। পাশাপাশি অনেকগুলো ব্রিজ ও কালভার্ট ভেঙে গেছে। সেগুলোও সংস্কার করতে হবে। গত বুধবার থেকে ক্ষতিগ্রস্ত সেতুগুলো সংস্কারে কাজ করছে সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগ। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে সড়কের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। পানি উঠে অনেক সড়কে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কার্পেটিং উঠে গেছে প্লাবিত প্রায় সব সড়কের। সড়ক ও সেতুর এপ্রোচ সড়কেও দেখা দিয়েছে ধস। বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক। পানি নেমে যাওয়ায় যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে পানির তোড়ে এই সড়কে তৈরি হয়েছে খানাখন্দ ও বড় বড় গর্তের। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সড়কগুলো।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর