সিলেটে ত্রিশ দিনের ব্যবধানে ফের বন্যা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ টানা বৃষ্টি ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে নদ নদীর পানি আবারও বেড়ে গিয়ে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গতকাল সর্বশেষ বিকেল ৩টার তথ্যনুযায়ী সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। এরইমধ্যে প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারা বাজারসহ চারটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল। বিগত ২০ দিনের ব্যবধানে আবার বন্যা দেখা দেয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সুনামগঞ্জের মানুষ। সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়ে গেছে।

শহরের উত্তর আরপিন নগর, তেঘরিয়া, বড়পাড়া, মধ্যবাজার, কাজির পয়েন্ট, জগন্নাথবাড়ি রোড, নতুনপাড়া, উকিল পাড়া, ষোলঘর, নবীনগর এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ, স্কুলের শিক্ষার্থীরা এবং ব্যবসায়ী। শহরের কিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করায় বাসা থেকে বের হতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হলে কোনও এলাকায় কোমড় আর কোনও এলাকায় হাটু পানি মাড়িয়ে তারপর বের হতে হচ্ছে।

বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। চাকরিজীবী স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা দাবি জানান সুনামগঞ্জকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে যেন সাধারণ ছুটি দেয়া হয়। এ ভাবে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে সুনামগঞ্জে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে ধারণা করছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে জেলার বন্যাকবলিত উপজেলায় এখনও জরুরি ত্রাণ না পৌছার কারণে বানবাসী মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। মধ্যবাজারের ব্যবসায়ী সুনীল বণিক জানান, সকাল থেকে রাস্তায় পানি আর একটানা বৃষ্টিতে কোন কাস্টমার নেই, বড় খারাপ অবস্থা এখানের। উত্তর আরপিন নগর এলাকার বাসিন্দা জামিলা বেগম বলেন, ঘরে পানি এখনও পানি ঢুকেনি। আর দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি বাড়লে বাড়লে আমার ঘরে পানি ওঠে যাবে। টানা বৃষ্টিতে আমরা আগে ক্ষতিগ্রস্ত হই।

ব্যবসায়ী শামসুল আলম রাজু বলেন, টানা বৃষ্টিতে বাসা থেকে বের হতে পারিনি। শহরে সব দিকে পানি। কোনও দিকে যাওয়ার মত অবস্থা নেই। আমি পাইকারি পণ্য সাপ্লাই দেই। আমার কাজের লোকজনও আসতে পারেনি। একদিনে আমার অনেক টাকা ক্ষতি হবে। বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হলে তো কি পরিমাণে লোকসান হবে তা বলে বুঝাতে পারবও না।

সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম  জানান, আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্যে সুনামগঞ্জে আরও ২ দিন বৃষ্টিপাত থাকবে। এসময় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল এলাকায় সৃষ্ট বন্যা মোকাবেলার জন্য সকল রকমের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রেরণ ও সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সজাগ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আরো জানান, সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় ইতোমধ্যে ২০ মেট্রিক টন করে খাদ্য সামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করার জন্য সবাইকে বলা হয়েছে। অনেক জায়গায় এখনও জরুরি খাদ্য সহায়তা পৌঁছেনি? এমন প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দেননি জেলা প্রশাসক।
সিলেট ব্যুরো জানায়, ফের বন্যার কবলে পড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে সিলেটের ৫টি উপজেলা। এক মাসের ব্যবধানে বন্যার নতুন গ্রাসে বিপর্যস্ত জনজীবন। টানা বর্ষন ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার পাঁচ উপজেলার তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। পানি ঢুকে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সুরমা ও কুশিয়ারাসহ জেলার সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধিও রয়েছে অব্যাহত। সুরমার পানি একাধিক পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ছাতক (সুনামগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জের ছাতকে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার সবত্রই এখন দেখা দিয়েছে বন্যা। এক মাসের ব্যবধানে আবারও বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক ঘর বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, মৎস্য খামার, গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট ও হাট-বাজার। উপজেলার সর্বত্রই এখন বন্যার পানি থৈ-থৈ করছে।

গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এখানে সুরমা, পিয়াইন, চেলা নদীসহ সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ও প্রবল বেগে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ধারণা ছাতকে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ইতোমধ্যে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলা সদরের সাথে ১৩ ইউনিয়নের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নোয়ারাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান পীর আবদুল খালিক রাজা জানান, ইউনিয়নে অনেক মৎস্য খামার, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে সকল হাটবাজার। শত-শত বসত ঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে।

ছাতক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, বন্যার পানি থানা আঙ্গিনায় প্রবেশ করেছে। থানার সামনের একমাত্র সড়কটিতে হাটু পানি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুনুর রহমান জানান, উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর এলাকায় ও অফিসে বন্যার পানি। পরিষদের অধিকাংশ বাসায়ও পানি ঢুকেছে। ছাতক পেপার মিল হাইস্কুল, বৌলা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মন্ডলীভোগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৬০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। প্রয়োজনে আরো আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হবে।

এদিকে, কুড়িগ্রামের রৌমারীতে গত ৬ দিন ধরে টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় পানি বন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। চলমান বন্যায় বাড়ির উঠোন কিংবা ঘরে পানি না উঠলেও চারপাশের রাস্তা ঘাট তলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এ অঞ্চলের মানুষজন।
চলাচলের জন্য নৌকা ও কলা গাছের ভেলা ছাড়া বিকল্প কোন পথ না থাকায় ঝুঁঁকি নিয়ে পারাপার হতে হচ্ছে শিশু কিশোর ও বৃদ্ধাদের। বিশেষ করে ভারি বর্ষণ ও হঠাৎ সৃষ্ট বন্যায় মাঠে থাকা খড় পানিতে ভেসে যাওয়ায় গো খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, রৌমারীতে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা সৃষ্ট বন্যায় ২ হাজার ৬৩ হেক্টর ফসল পানির নিচে নিমজ্জিত রয়েছে। এর মধ্যে ভুট্টা, তিল ও পটল ক্ষেতসহ আউশ ব্রি ৪৮ ধান রয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বে। যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবো গফুর জানান, আমার ইউনিয়নের দুটি গ্রামে শতাধিক পরিবার পানিবন্দি। ব্রহ্মপুত্রের পানি এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে অনান্য এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হতে পারে।

রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ইনকিলাবকে জানান, রৌমারীতে চলমান বন্যায় দূর্যোগ কবলিত এলাকাগুলোর মানুষের জন্য ৩ লাখ টাকার গো খাদ্য ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে বিতরণ করা হবে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, কুড়িগ্রামে আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে বন্যা হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। তবে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। এখনও সবগুলো নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর