অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু

আবেদা আক্তার জাহানঃ
বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনকে ঘিরে সদ্য প্রয়াত একুশের গানের রচয়িতা লন্ডনপ্রবাসী প্রখ্যাত কালজয়ী লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণমূলক এক লেখার উদ্ধৃতি এখানে না দিলেই নয়। তিনি লিখেছেন, ”Gaffar I have created a history. I was very much to make it a saccess. If I fail, I will go to oblivion for a long time.’

ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু কথা ক’টি বলেছিলেন, যার অর্থ –  ‘গাফ্ফার, আমি একটি ইতিহাস তৈরি করেছি। তার সাফল্য আমি দেখে যেতে চাই। যদি এই সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হই, তাহলে আমি দীর্ঘদিনের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাব।’

মহামানবের কথা ঠিকই ফলেছিল। ওই বছরেই তাকে হত্যা করে তার রচিত ইতিহাস মুছে ফেলার চক্রান্ত হয়েছিল। দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণেও অন্তরায় ছিল। হন্তারকের দলের নেত্রী বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিবসে নিজের মনগড়া জন্মদিবস মহাজাঁকজমকে উদযাপন করতেন। ইতিহাসের সেই মলিন অধ্যায় আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কালো মেঘের আড়াল থেকে সত্যের সাহসী সূর্য বেরিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতার মহা আসনে অধিষ্ঠিত তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। এতে ইতিহাসে মুজিব যুগের একটি শাশ্বত অধ্যায় যুক্ত হয়েছে, যা আর কেউ কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না।

দুই.
‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। বাংলার মধ্যযুগের এক কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী।

সমগ্র বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত, রক্ত ঝরেছে যখন পৃথিবীর নরম শরীর থেকে, তখন এই বাংলার এ কবি বিশ্বকে শুনিয়েছিলেন মানবতার অমর কবিতা।

পদ্মা, গঙ্গা, বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে সহস্র বছর ধরে যে মানুষের বসবাস, তাদের সংগ্রামী জীবনের উত্তরাধিকার আমরা। সে জীবন অবিভাজ্য মানুষের। সে জীবন শ্রম ও আনন্দের। শান্তি ও সমন্বয়ের। প্রকৃতিও গঠিত পুরানো সংশ্লেষে।

সেই জীবনের সংস্কৃতি সততই প্রেমের জয়গান গায়। জীবনের জয়গান গায়। যুগে যুগে মানবের কল্যাণ কামনায় গীত হয় সাম্যের গান। জাতি-বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে মানুষের জীবন ও জাতিসত্তা নির্মাণের প্রধানতম নিয়ামক। সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা বিলুপ্ত হয় মানবজীবন থেকে উৎসারিত ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় বিভাজন অনুমোদন করে না। আর তাই এই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ অনেক মানবিক ও শান্তিকামী।

এই সোনার বাংলা স্বাধীন হয় একাত্তরে। তা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে; এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আর লাখো মা-বোনের সম্ভমহানিতে ও কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতিতে। এর আগে ১৯৪৭ সালে কলমের আঁচড়ে পাকিস্তানের জন্ম হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, যেখানে লালন করা হয় সাম্প্রদায়িক চেতনা। এসব পরিলক্ষিত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতায়, যা আজও স্মুতির আয়নায় প্রতিবিম্ব হয়।

আমার বাবা কিশোরগঞ্জ জেলার পুলেরঘাট চিনিকলের হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। সেই সুবাদে আমার শৈশবকালের বেশ লম্বা একটা সময় সেখানেই কেটেছে। আমাদের বসবাসের কোয়ার্টারের পাশেই ছিল উচ্চ বংশীয় জমিদার সতী বাবুর বাড়ি। তাদের সাথে  ছিল আমাদের ঐকান্তিক সখ্যতা; বাড়িতে ছিল অবাধ যাতায়াত। সে সাথে পড়াশোনা ও খেলাধুলাসহ বেড়ে ওঠা। শুনেছি একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরিবারটির ওপর পাক হানাদার বাহিনী অপারেশন চালিয়ে অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রাসাদ্যোম বাড়িটি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। প্রাণ বাঁচাতে কেউ কেউ পালিয়ে কলকাতায় চলে যায়।

স্বাধীনতা-উত্তর তারা আদি নিবাস বাংলাদেশে ফিরে এলেও পচাত্তরের আগস্ট ট্রাজেডির পরবর্তী পরিস্থিতিতে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূলমন্ত্রই ছিল সেকুলারিজম বা অসাম্প্রদায়িকতা, যা বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু বিশাল হৃদয়ে ধারণ ও একনিষ্ঠতার সাথে পালন করে গেছেন।

এ সম্পর্কে ব্রিটেনের একজন রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক টনি বেন (লর্ড ওয়েজউড বেন) লিখেছেন, ‘নেহেরু জিন্না দু’জনেই পশ্চিমা দেশে এসে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, ব্রিটিশ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে হিন্দু ভারত ও মুসলিম ভারতে ভাগ করেছিলেন।

কিন্তু শেখ মুজিব বিদেশে এসে শিক্ষা লাভ না করেও দেশের মাটিতে বড় হয়ে উপমহাদেশে প্রথম একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, সমগ্র ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো নেতা।’

এই কথাটি যে কত সত্য, তার প্রমাণ, এককালে বিশ্বের মানুষ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের নামে ভারতকে চিনত (এখনও চেনে)। এখন শেখ মুজিব বললেই সারা বিশ্বের মানুষ চেনে স্বাধীন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ মানেই মুজিব। মুজিব মানেই বাংলাদেশ।

তিন.
বঙ্গবন্ধু ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের পরম আত্মীয়। পৃথিবীর খুব কম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁর মতো এতটা ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা লাভ করতে পেরেছিলেন। তিনি সবসময় ভাবতেন, সকল বাঙালি তাঁর বন্ধু। এর জন্যই বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তার নিজের বা পরিবারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না। আর এই বিশ্বাস থেকেই সরকারি বাসভবনের বদলে তিনি থাকতেন তাঁর প্রিয় বাসভবন ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসায়।

বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এ বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর অসম্ভব প্রিয় ছিল। কিন্তু তাঁর এই অগাধ বিশ্বাসের কোনো আস্থা রাখেনি বা মূল্য দেয়নি অকৃতজ্ঞ বেপথু কতিপয় স্বদেশীয সেনাসদস্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা ভীরু কাপুরুষের মতো বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে স্বশস্ত্র আক্রমণ চালায়। যে আক্রমণের বর্বরতা ইতিহাসে বিরল।

হামলার পর দেখা গেছে ভবনটির প্রতিটি ফ্লোরের দেয়াল, জানালার কাঁচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে তরতাজা মৃতদেহগুলো পড়ে আছে। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে পড়ে আছেন স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিথর দেহখানি। হায়েনাদের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছে তার বিশাল বুকখানি। ঘাতকরা সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে উপস্থিত সবাইকে হত্যা করে। রেহাই পায়নি আট বছর বয়সের নিষ্পাপ ছোট্ট শিশু বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলও।

এভাবেই নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে রচিত হয় বাঙালি জাতির জন্য আরও একটি কালো অধ্যায়। মা মাটি ও মানুষের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা ও স্বদেশকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোটাই কী তবে ছিল তাঁর অপরাধ? তাঁর পরিবারের?

যে মানুষটির জন্ম না হলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক ছোট্ট দেশটি অঙ্কিত হতো না। পেতাম না সবুজ জমিনের মাঝে রক্তের আঁকড়ে পতাকা। উদ্যাপন করা হতো না বাংলা নববর্ষ; নবান্ন উৎসব। জাতীয় সংগীতও গাওয়া হতো না ‘আমার সোনার বাংলা’। তাছাড়া আর কত কি। অথচ এদেশের মানুষের হাতেই কি না জাতির জনকের রক্তে রঞ্জিত হয় পবিত্র স্বাধীন ভূমি। একথা মনে হলে বিষাদে কাতর হই বড়।

লাশ ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়ায় এনে রেডক্রিসেন্টের দুঃস্থদের ত্রাণের শাড়ি কাপড় দিয়ে কাফন পরিয়ে জাতির সূর্য সন্তানের দাফনও সম্পন্ন হয়েছিল কড়া নিরাপত্তা ও দ্রুততম সময়ের মধ্য দিয়ে। খুনিরা ভয়ে আতঙ্কে ছিল প্রিয় জন্মভূমিতে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে না আবার তর্জনি উঁচুই। গর্জে না ওঠেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো।’

চার.
বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার পরে এ ধরনের প্রতিদান অকল্পনীয়। বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে সেদিন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কোনো একটি দেশের স্থপতি ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে তাঁর পরিবারের সদস্যসহ এমন নির্মম ও ভয়াবহ হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেদিনকার হত্যা শুধু বঙ্গবন্ধুর হত্যা ছিল না। হত্যা করা হয়েছিল একজন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও যুগস্রষ্টা প্রতিষ্ঠাতাকে। জনগণের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া একজন মহান ব্যক্তিত্বকে। ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী প্রণেতাকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে। যে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাঙালি জাতির চিন্তা, চেতনা ও আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর রচিত ইতিহাস মুছে ফেলার চক্রান্ত হয়েছিল। দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণে সহ্য করা হতো না। হন্তারকের দলের নেত্রী তাঁর মৃত্যু দিবসে নিজের মনগড়া জন্মদিবস মহা জাঁকজমকে উদযাপন করতেন।

জাতির পিতাকে হত্যার ৪৬ বছর পরে বাংলাদেশের অনেক পট পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতার মহা আসনে অধিষ্ঠিত এখন যোগ্য উত্তরসূরি। ২০২০-২১ সাল পালিত হয়েছে মুজিববর্ষ হিসেবে। বঙ্গবন্ধু আজ আর শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, তিনি বিশ্বের নেতা, বিশ্ববন্ধু। উপমহাদেশে অশোকবর্ষের পর আর কোনো বর্ষ নেই। যুক্ত হলো মুজিববর্ষ।

সান্ত্বনা এখানেই, শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার কাজ এ দেশের মাটিতেই হয়েছে। অথচ এই বিচার কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল তাঁর হত্যার পরবর্তী সময়েই। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খুনি খন্দকার মোশতাক তা তো করেই নি; বরং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে জঘন্যরকম এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই এই আইনটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় বাংলাদেশের সংবিধানে।

শেষতক শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমর্থ উত্তরাধিকারী টানা তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বধীন সরকার স্বল্পোন্নত থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নশীল’ দেশের কাতারে ওঠে এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সামাজিক উন্নয়ন – যে কোনো সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অভূতপূর্ব। সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্যতা হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই বিশ্বে বাংলাদেশ এক বিস্ময়ের নাম।

বঙ্গবন্ধু তুমি জিতেছো, জিতেছে বাঙালি। কবি ভাষায় বলতে চাই- ‘দেশের তরে মানবের তরে, জীবন করেছো নিঃশ্বেষ / তোমার প্রতি লাখো সম্মান আর শ্রদ্ধায় নত এ দেশ।’

লেখক: প্রধান শিক্ষক
তমিজা খাতুন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
মিঠামইন, কিশোরগঞ্জ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর