আমরা এখন ছি ছি’র পাত্রী: নূতন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’ এর নায়িকা ও ঢাকাই সিনেমার এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী নূতন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। সর্বশেষ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে তাকে পারফর্ম করতে দেখা গেছে। চলচ্চিত্রের বর্তমান, ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে জানতে রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ বিনোদন প্রতিবেদক কথা বলেন নূতনের সঙ্গে। আলাপচারিতার বিশেষ অংশ তুলে ধরা হলো।

রাহাত: আপনি সব সময় হাসিমুখে থাকেন। ঠাট্টাপ্রিয় মানুষ। সবার সঙ্গে আপনার সুসম্পর্ক- এর রহস্য কী?

নূতন: আমি মারা গেলে আমার সঙ্গে যেন তোমার-তোমাদের কোনো না-কোনো স্মৃতি মনে পড়ে এ কারণেই আমি সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশে যাই, চলাফেরা করি। সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার পর্যায়ে আমরা এখন চলে এসেছি; সিনেমার কথা হয়তো ভুলেও যাবে, তবে আমার ব্যবহার থেকে যাবে সারাজীবন। সম্ভব হলে আমি ১৮ কোটি মানুষের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতি ধরে রাখতাম। যদিও আমি জানিয়ে দিয়েছি- মারা গেলে যেনো এফডিসিতে আমাকে না নেওয়া হয়। আর কেউ যেন আমাকে নিয়ে মায়াকান্না না কাঁদেন। আমার জন্য মন থেকে একজন মানুষ দোয়া করলেও আমি স্বার্থক।

রাহাত: যে এফডিসিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এতো এতো স্মৃতি। অথচ মৃত্যুর পর লাশ এফডিসি প্রাঙ্গণে নিতে না করছেন। এর পেছনে ক্ষোভ বা কষ্ট আছে নিশ্চয়ই।

নূতন: এটা তোমাদের খুঁজে বের করতে হবে। নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছি। একজন শিল্পী এত বছর এই এফডিসিতে কাজ করেছে, যার জীবনটাই এখানে কেটেছে। যার ভালোবাসা এখানে দিয়েছে সে এ কথা কখন বলে? নিশ্চয়ই সে সেরকম কোনো আঘাত পেয়েছে বলেই কথাটা বলছে। মানুষের যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছি এর থেকে উপরি কিছু চাইনি, চাইবোও না।

রাহাত: চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

নূতন: স্পষ্টবাদী হওয়া এখন অপরাধ। এখানে স্পষ্ট কথা বলা যায় না। আমি অনেক সময় অনেক কথা বলে ফেলতাম। সিনিয়ররা বলতেন- নূতন তুমি ঠিক বলেছ। এখন তো কেউ কারো কথাই শোনে না। আমাদের মধ্যে কখনও কোন্দল কাদা ছোড়াছুড়ি হয়নি। আমাদের মধ্যে যেটা হয়েছে চুপচাপ সবাই বসে সমাধান করে ফেলতো। হঠাৎ করেই কেন যেন সব পাল্টে গেল! মনে হচ্ছে এফডিসি কিছু না, অভিনয়ের দরকার নেই, সিনেমা হলের কি অবস্থা, সিনেমা নেই, শিল্পীদের সবাই হাহাকার করছে- এসব নিয়ে কোনো কথাই নেই। সবাই কি গিয়ে বলবে- ভাই আমার খাবার নেই৷ সব শিল্পীই কি কোটি টাকা নিয়ে বসে আছে? এটা ভুল ধারণা। এখন চেয়ার নিয়ে টানাটানি করছে। সবাই তো একসঙ্গে ছিল। সবাই মিলে সমাধান করা যেত। কেন বাহিরের লোক জানবে? কেন বাহিরের লোক এগুলো নিয়ে ছি ছি করবে? যারা আমাদের ছবি দেখে আমাদের ভালোবাসে, তাদের মুখে এখন আমরা ছি ছি’র পাত্রী!

রাহাত: শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে কী বলবেন?

নূতন: নির্বাচনের আগে ভাই-বোন আত্মীয়। নির্বাচন হয়ে গেলে আর চেনে না। পাস করার পর একটা হাই হ্যালো পর্যন্ত নেই। এটা সবার ক্ষেত্রেই দেখলাম। শিল্পীদের জন্য কিছু করতে হলে এত কিছু করতে হয় না। আমি করবো-ইনশাআল্লাহ আল্লাহর নাম নিয়ে নেমে যাব। কেউ দেখুক আর না দেখুক। আল্লাহ তো দেখবেন। সবাই আমরা একই জায়গার মানুষ। মিশা ভাই বলো, জায়েদ বলো, নিপুণ বলো, কাঞ্চন ভাই বলো সবাই একই জায়গার মানুষ। আমাদের প্রথম কাজ হলো এফডিসি বাঁচানো। এটা বাঁচলে শতশত শিল্পী কলাকুশলীরা বাঁচবেন।

এর আগেও আমি অনেকের জন্য নির্বাচনে কাজ করেছি। এবারো কাজ করেছি। আমি বুঝে গেছি যখন যে পাস হয়ে যায় তখন ভুলে যায়। এরা স্বার্থ ফুরালে সব ভুলে যায়। আমি কার জন্য করিনি? চেয়ারটা মুখ্য না। চলচ্চিত্র মুখ্য। সিনেমা যদি না থাকে, হল যদি না থাকে তাহলে এই চেয়ার নিয়ে টানাটানি করে কি লাভ?

রাহাত: আপনাকে অনেক সাপের সিনেমায় দেখা গিয়েছে।

নূতন: আমি নতুন প্রভাতের মাধ্যমে রাজ্জাক ভাইয়ের পছন্দ অনুযায়ী সুমিতা দেবীর হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসি। তখন আমার অভিনয় দেখার পরে আমাকে অনেক চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেত্রী করা হয়। তখন সুপারস্টার শাবানা আপা, কবরী আপা, সুচন্দা আপা, ববিতা আপা, অলিভিয়া আপা, শবনম আপা মানে এদের মধ্যে কোনো রকম কাজ করাই ছিল মুখ্য। তারপর আমার সমসাময়িক অঞ্জনা, রোজিনা, সুচরিতা, চম্পা, অরুণা, অঞ্জুরা তো ছিলোই। আমার প্রথম দিকে কোনো জুটি ছিল না। আমার ওস্তাদ প্রয়াত সুমিতা দেবীর কথা ছিল- অভিনয় শেখা আর অভিনয় করাটাই মুখ্য, চরিত্র যাই হোক। যে কারণে অনেক পার্শ্বচরিত্র করতে হয়েছে। একদিন আমার আরেক অভিভাবক প্রয়াত জসিম বললেন, তুমি এককভাবে কাজ করো। এভাবে আর না। আমি একটু ধাক্কা খেলাম- কি করবো উপায় না পেয়ে শুরু করলাম সাপের ছবি করা। তখন ছবি মানেই পারিবারিক বা সাপের ছবি আর অ্যাকশ্যান ছবিতে নায়িকার কাজ নাই। প্রথম ২/৩ টা সাপের ছবি ভালো গেলো তারপর যা হয় আরকি! অনেক সাপের ছবি করা হয়েছে একক অভিনেত্রী ও নাচের দক্ষতার জন্য।

রাহাত: জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা দিলদারের সঙ্গে ‘আব্দুল্লাহ’ সিনেমা করার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।

নূতন: দিলদার ভাইয়ের সঙ্গে ‘আব্দুল্লাহ’ কেউ করবে না; অনেকেই ফেরত দিয়ে দেয়। নাম থাকবে না- এই সেই। আমি নূতন বলছি, আমার সঙ্গে যদি কলাগাছ আইনা দাও আমি কাজ  করবো, সে যেই হোক। কারণ আমি ছোট ছোট কাজ করেই আমার জায়গা পোক্ত করেছি। আব্দুল্লাহ সুপার হিট হয়। আমি করেছি বলেই যে হিট তা নয়। দিলদার ভাই আমাকে এতো ভালোবাসতো যে একদিন চোখে পানি নিয়ে বলেছিল- আমি তোমার নায়ক হলাম, তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি দিলদার ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক শিখেছি। তার সম্মান প্রদর্শন ছিল চোখে লাগার মতো। বাংলাদেশে আরেকজন দিলদার আসবে না।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর