বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে মোবাইল ফোন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সাব্বির (ছদ্মনাম), বয়স ১৯ বছর। বেশ কয়েক বছর ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করছে।

নাইম (ছদ্মনাম) বয়স ২১ বছর। সারাদিনই মোবাইলের গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। খিটখিটে মেজাজ থাকে সব সময়। উদাসীন মনোভাবের কারণে সাব্বির ও নাইমের অভিভাবকও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

উপকূলের এমন চিত্র এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। শহরের কিশোর-কিশোরীদের চেয়ে বেশিমাত্রায় ঝুঁকছে উপকূলের কৈশোররা। ওয়াপদার ঢালে, গাছের নিচে, মাঠে, ঘাটে, বিদ্যালয় বা পরিত্যক্ত ভবনের ছাদে, স্কুল-কলেজের মাঠে খেলাধুলার বিপরীতে দেখা যায় মোবাইল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে ফেসবুক-ইউটিউব-টিকটক নিয়ে ব্যস্ত। উপকূলের এমন চিত্র এখন দৃশ্যমান। অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে উঠতি বয়সী কিশোরেরা পথভ্রষ্ট হচ্ছে। একেতো বয়ঃসন্ধিকাল কিশোরদের শারীরিক, মানসিক পরিবর্তন থেকে নানা ঝুঁকি থাকে এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে মোবাইল ফোন। দিনের অধিকাংশ সময়ই সব বয়সীরা ফোন ব্যবহার করেন। এরমধ্যে কৈশোরদের উপস্থিতি দেখা মেলে বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে দিনরাত মোবাইল ব্যবহারের কারণে মানসিক, স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলছে, পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনানুযায়ী বিয়ের বয়স না হলেও অনেক অভিভাবক সন্তানদের দ্রুত বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০-১৯ বছরের মধ্যে শিশুদের শারীরিক পরিবর্তন হয়। এই সময়টাতে তাদের মধ্যে এক ধরনের লাজুকতা কাজ করে। ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ, ১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। যা এদেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। অথচ তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি বাংলাদেশে এখনও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এ অবস্থায় পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। উপকূলের কৈশোরদের চিত্র আবার কিছুটা ভিন্ন। ১১-১২ বয়স হতেই হয়ে যায় পুরো পরিবর্তন। সাগর ও নদীতে তাজা মাছে আমিষ ও আয়োডিন বেশি থাকায় দ্রুত পরিবর্তন হয় বলে দাবি উপকূলের সচেতন মহলের।

সম্প্রতি কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, মোবাইল ফোন থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নির্গত হয়। ফোনের অ্যান্টেনা মানুষের শরীরের নিকটতম কোষের শক্তি শোষণ করে নেয়। মোবাইল ফোনের ব্যবহার মস্তিষ্কে গ্লাইমাসসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। থাইরয়েডের সমস্যা, মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে উত্তেজনাকারী হরমোনের মাত্রায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন থাইরয়েড হরমোনের স্বাভাবিকমাত্রা বন্ধ করে দিয়ে হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি থাইরয়েডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনের ফলে শুক্রাণু তিন গুণ দ্রুত মরে যেতে পারে। এছাড়া শুক্রাণুর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তে পারে। এটি পুরুষদের স্বাস্থ্য ও উর্বরতার জন্য মোটেও ভালো খবর নয়।

কালমেঘা ইউনিয়নের সাব্বিরের (ছদ্মনাম) পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারাদিনের বেশিরভাগ সময়ই মোবাইল নিয়ে থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল ব্যবহার করে। প্রথম থেকে নিষেধ কিছুটা মানলেও এক পর্যায় এসে কিছুই তোয়াক্কা করছেনা। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দুই হাত দিয়ে কি যেন খেলছে। তারা আরও বলেন, কয়েক মাস ধরে ছেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শরীর শুকিয়ে গেছে, চোহারা ভেঙে গেছে। খিটখিটে মেজাজ থাকে, কোনো কথা বললে শুনতেই চায়না। নিজের মতো করে চলাফেরা করে। বরিশাল ও খুলনায় দুইবার ডাক্তার দেখানো হয়েছে।

চিকিৎসরা বলেছেন, অতিমাত্রায় মোবাইল ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসা দরকার এবং দ্রুত বিবাহ দেওয়ারও পরামর্শ দেন। একই গ্রামের নাইম, নয়ন, প্রদীপ কুমারসহ একাধিক কিশোরের অবস্থা এমনই।

কাকচিড়া ইউনিয়নের রাবেয়া আক্তারের (ছদ্মনাম) এক বছর আগে বিয়ে হয়। বিবাহের দুইদিনের মাথায়ই কাজী অফিসে গিয়ে স্বামীকে তালাক দেন। দুইদিনে স্ত্রীকে সময় না দিয়ে মোবাইলে গেমস, ইউটিউব নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিকাহ্ রেজিস্ট্রার (কাজী) বলেন, রাবেয়া নিজেই স্বামীকে তালাক দেন। তালাকের কারণের কলামে স্বামীর অমতা উল্লেখ করেন ওই মেয়ে। এর সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের রুবেলের (ছদ্মনাম) সঙ্গে বিয়ে হয়।

এ সূত্র ধরে ওই গ্রামে গিয়ে জানা যায়, রুবেল এসএসসি পরীক্ষার পরে আর লেখাপড়া করেনি। করোনার কারণে লেখাপড়া বন্ধ থাকার সুযোগে সেদিকে আর মন বসেনি তার। মন বসে যায় মোবাইলের দিকে। সারাক্ষণই মোবাইলে ফেসবুক, গেমস, ইউটিউব নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটিয়ে দেন। সঙ্গদোষ আর মোবাইলে আসক্তি হওয়ায় মেজাজ খিটখটে হয়ে যায়। শরীরে পরিবর্তন দেখা দিলে খুলনায় চিকিৎসায় নিয়ে যান পরিবার। সেখানকার চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্রুত বিবাহ দেওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী বিয়ে দিলেও তা আর দাম্পত্য সম্পর্কে রূপ নেয়নি। দুদিনের মাথায়ই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আর সেই বিচ্ছেদের কারণও উল্লেখ করা হয় ‘স্বামীর অমতে’।

নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের তথ্য মতে, পাথরঘাটা পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২০২১ সালে বিবাহ হয়েছে ১৪৮টি, তার মধ্যে উভয়ের সম্মতিতে তালাক হয়েছে ৬৭, স্ত্রী কর্তৃক তালাক হয়েছে ৫৩টি। কালমেঘা ইউনিয়নে একই সনে বিবাহ হয়েছে ৩৪৭টি, এর মধ্যে তালাক হয়েছে ১১১টি। তার মধ্যে ৮৬টি তালাক হয়েছে স্ত্রী কর্তৃক। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্বামীর অমত, পরকীয়া, দাম্পত্য ও পারিবারিক কলহই তালাকের কারণ।

সৈয়দ ফজলুল হক ডিগ্রি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নুরে জান্নাত বাংলানিউজকে বলে, আমাদের জন্য এ বয়সটা খুবই ঝুঁকি। এ বয়সে এমনিতেই অন্যায় অপরাধ এবং পথভ্রষ্ট কাজে ঝুঁকে পড়া সহজ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোবাইল ফোন। তথ্য প্রযুক্তিতে অনায়াশেই সবকিছু এক কিকেই দেখা যায়। এ কারণে কৈশোর বয়সে পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। তাই এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো নিজের জরুরি এবং লেখাপড়ার কাজে যতোটুকু দরকার ততোটুকুই মোবাইল ব্যবহার করা এজন্য মানসিক পরিবর্তন আনতে হবে এবং অভিভাবকদেরও সচেতনসহ সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

নারী নেত্রী মুনিরা ইয়াসমিন খুশি বাংলানিউজকে বলেন, উপকূলের ছেলে-মেয়েরা ১১-১২ বছর বয়েসেই পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে মেয়েদের পরিবর্তন হয়। এ পরিবর্তনের সঙ্গে মোবাইলযুক্ত হওয়ায় নতুন করে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় মেয়েদের। এটি নিয়ে ভাবতে হবে। এছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে উপকূলের মেয়েদের ঝুঁকির কাজ করায় পিরিয়ডকালীন অনেক সমস্যায় পড়ে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বয়ঃসন্ধিকাল শুরু থেকে আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে, মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন হয়। তার কী পছন্দ-অপছন্দ, সে কী চায়। এছাড়া নিজের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এ সময়টা মূলত কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়। এ সময়টা ভালমন্দের একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে স্মার্টফোন নিত্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির যুগে এসে মানসিক পরিবর্তনের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে মোবাইল। বেশিরভাগ সময় এখনকার কৈশোররা মোবাইলে আসক্তি থাকে। যে কারণে মেজাজ খিটখটে, উগ্র-মনোভাবসহ মানসিক নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, পথভ্রষ্ট হচ্ছে। খুব সহজে মোবাইল থেকেই অশ্লীল ভিডিও দেখার কারণে শারীরিক সমস্যাসহ যৌন সক্ষমতা কমে আসে। এর প্রভাব এখনই কিশোরদের শারীরিক গঠন পরিবর্তন ও মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়।

পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে কৈশোরদের স্বার্থে সরকার, সমাজ, পরিবার ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। মোবাইল ফোনের ব্যবহারের সুফল-কুফল সম্পর্কে কৈশোরদের সচেতন করতে হবে। তা না হলে একটা সময় এসে সামাজিক অবয়, অপরাধ বৃদ্ধি পাবে এবং প্রজনন মতাও কমে যাবে। বিশেষ করে উপকূলের শিশুদের মোবাইল আসক্ত হওয়ার সংখ্যা যেভাবে দিন দিন বাড়ছে তা আমাদের সত্যিই ভাবিয়ে তুলছে। গ্রামের ঐতিহ্য একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই সময় প্রতিকারের, পাশাপাশি নব উদ্ভাবিত এই সমস্যার দেশীয় সমাধান খুঁজতে পর্যাপ্ত গবেষণা করতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল ভিডিও বার্তায় বলেন, যখন যে বয়সে করার কথা নয়, প্রাইমারি স্কুলে আমাদের ছেলেরা অ্যান্ড্রয়েড ফোন পেয়ে যাচ্ছে, পেয়ে গেলে কি হবে তারা ইউটিউবে ঢুকছে, আজে-বাজে ভিডিও দেখছে। শিশু থেকে শুরু করে বুড়োরা সবাই কিন্তু পর্নসাইটগুলো দেখে। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্রেইনের হাইপোথ্যালামিক নামে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আছে যা সক্রিয় বা বয়স হওয়ার আগেই ব্যবহার করবে, আগেই হরমোনের জোয়ার আসে শরীরে, তার আগেই সেক্সুয়াল দানবের মতো তাকে প্রভাবিত করবে, তখন পার্টনার খুঁজবে, সে ধর্ষণ করবে, তার নৈতিকতা চলে যাবে। এটাকে ভোগের বস্তু মনে করবে। এইভাবে আমাদের ছোট-ছোট শিশুদের মধ্যে ভোগবাদিসত্ত্বা বসে যাচ্ছে। এর ফলে শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নেমে যাবে। যেখানে ভোগবাদিসত্ত্বা আধিপত্য পাবে, সেখানে অপরাধ হবে, সেখানে ধর্ষণ হবে, সেখানে পরকীয়া হবে, সেখানে বিয়ে ভেঙে যাবে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা হবে।

তিনি আর বলেন, যেখানে নৈতিক সত্ত্বা বসার কথা, যেখানে আমাদের সামাজিক অনুশাসন বসার, যেখানে আমার বুদ্ধিভিত্তিক অনুসঙ্গগুলো আমাকে প্রভাব বিস্তার করার কথা, যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন প্রভাব বিস্তার করার কথা এমন সময় আমরা অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতে পেয়ে যাই তখন আমরা নিষিদ্ধ জগতে ডুবে যাই, ভোগবাদিসত্ত্বাকে লালন করে, ধারণ করে। ওটাই ধ্যান জ্ঞান হয়ে যায়। এ কারণে আমাদের বিপর্যয় ঘটে যায়। প্রতিটি ধর্ম কিন্তু যৌনতাকে একটি শৃঙ্খলার মাধ্যমে নৈতিক শাসনের মাধ্যমে বড় করার কথা বলেছে। সেই শাসনটা আমাদের নেই। আমি মনে করি এগুলো থেকে মুক্তি পেতে হলে, ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক শিক্ষা এবং ভালো মন্দের পার্থক্যটা বুঝাতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর