উচ্চফলনশীল বিনাহলুদ-১, হেক্টরে ফলন ৩৩ টন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রতিবছর বাংলাদেশ কোটি টাকার মসলা আমদানি করে। তবে, কৃষকদের মাঝে বর্তমানে মসলা জাতীয় ফসল চাষে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছে। তেমনই উচ্চফলনশীল মসলা ফসল বিনাহলুদ-১। যার হেক্টরে ফলন ৩০-৩৩ টন।

উচ্চফলনশীল বিনাহলুদ-১ জাতের বৈশিষ্ট্যঃ একটি আধুনিক উচ্চফলনশীল জাত, প্রচলিত জাতের তুলনায় ফলন বেশী। গাছ লম্বা আকৃতির, পাতা গাঢ় সবুজ এবং লম্বা। পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ১২৫-১৩৫ সে.মি.। পাতার সংখ্যা ১৬-২২ টি এবংপাতার দৈর্ঘ্য ৫৫-৬৫ সে.মি.।

প্রতি গাছে ছড়ার সংখ্যা ২৮-৩৫ টি। ছড়া ১২-১৫ সে.মি.লম্বা এবং ৩-৫ সে.মি. চওড়া। প্রতি গাছে হলুদের ওজন ৮৫০-১০০০ গ্রাম। শাঁস আকর্ষণীয় গাঢ় হলুদ এবং শুষ্ক পদার্থের পরিমান শতকরা ৩৮-৪৫ ভাগ। লিফব্লচ এবং রাইজোম রট রোগ সহনশীল। বপনের ২৮০-৩০৫ দিনের মধ্যে ফলন সংগ্রহ করা যায়। জাতটির হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ৩০-৩৩ টন।

 

উচ্চফলনশীল বিনাহলুদ-১ চাষের জন্য মাটি বেলে-দোয়াঁশ ও পলি-দোয়াঁশ মাটি হলুদ চাষের জন্য উপযোগী। মাটি গভীরভাবে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরী করতে হবে। মাটি যাতে ঝুরঝুরে হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শেষ চাষের আগে ফুরাডান ৫ জি হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ কেজি করে প্রয়োগ করতে হবে। অবশ্যই সেচ প্রয়োগ ও পানি নিষ্কাষনের ভাল ব্যবস্থা থাকতে হবে।

কৃষকরা চাষ করতে চাইলে সাধারনত মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে পর্যন্ত (বৈশাখের শুরু থেকে শেষ পর‌্যন্ত) হলুদের কন্দ রোপন করতে হয়। রোপনের জন্য পরিপুস্ট, চকচকে ও রোগবালাইমুক্ত কন্দ নির্বাচন করতে হবে।

হেক্টর প্রতি ২.০-২.৫ টন কন্দের (রাইজোম) প্রয়োজন হয়। প্রায় ৫০ গ্রাম ওজন বিশিষ্ট বীজকন্দ থেকে ভাল ফলন পাওয়া যায়। বীজবাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে কন্দ শোধন করে নেয়া উচিত। রোপনের ৪-৬ ঘন্টা আগে ব্যভিস্টিন/স্কোর ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কন্দ ৩০-৪০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, তারপর পানি থেকে কন্দ তুলে নিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।

জমিতে ৬০ সে.মি. পরপর সারি টেনে সারিতে ২৫ সে.মি.পরপর ৫-৭ সে.মি.গভীরে বীজকন্দ রোপণ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য দুই সারির মাঝখানে ৬০ সেমি প্রশস্ত নালা রাখতে হবে। পরবর্তীতে দুই সারির মাঝের নালা থেকে মাটি উঠিয়ে গাছের গোড়ায় দিতে হবে।

হেক্টর প্রতি সারের মাত্রা; গোবর-৫ টন, ইউরিয়া-২২০ কেজি, টিএসপি-১২০ কেজি, এমপি-২২০-কেজি, জিপসাম-১০০ কেজি এবং বোরন-২ কেজি। মাটির উর্বরতার উপর ভিত্তি করে সারের পরিমান কম বেশি হতে পারে। শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, বোরন এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমপি সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া এবং এমপি সার সমান দুই কিস্তিতে ৭০-৮০ দিন এবং ১০০-১২০ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।

হলুদের জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে, সেক্ষেত্রে জমির অবস্থা বুঝে ৩-৪ বার আগাছা পরিস্কার করতে হবে এবং ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।পানি নিষ্কাশন এবং রাইজোমের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ২-৩ বার হলুদের দুই সারির মাঝে থেকে মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হবে এতে কন্দের বৃদ্ধি ভাল হবে। মাটি শুষ্ক হলে হালকা সেচ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পানি কোনভাবেই জমিতে না জমে থাকে। জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। জমিতে রস সংরক্ষণ এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের জন্য মালচিং (শুকনো পাতা বা খড়) দিতে হবে। এতে করে আগাছার পরিমানও কম হবে ।

রোগবালাই এবং পোকা মাকড় এর আক্রমন প্রচলিত জাতের তুলনায় অনেক কম। এ জাতটি লিফব্লচ এবংরাইজোম রট রোগ সহনশীল।

হলুদের পাতা লিফব্লচ রোগে আক্রান্ত হলে পাতার উপর থেকে সাধারনত শুকিয়ে যায় ফলে গাছ খাদ্য উৎপাদন করতে পারেনা, ফলন কমে যায়। এ রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ছত্রাকনাশক যেমন অটোস্টিন/ব্যাভিস্টিন ২ গ্রাম অথবা ফলিকুর ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ বার সম্পূর্ণ পাতায় ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

হলুদে কন্দপঁচা রোগের আক্রমন হলে গাছের নিচের দিকের পাতা হলুদ হতে থাকে এবং পুরো গাছ শুকিয়ে মারা যায়। আক্রান্ত গাছ হাত দিয়ে টান দিলে সহজেই উপরে উঠে আসে। কন্দপঁচা রোগ যাতে না হয় সেজন্য সুস্থ কন্দ বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বীজশোধন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । মাঠে এ রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ছত্রাকনাশক যেমন অটোস্টিন/ব্যাভিস্টিন ২ গ্রাম অথবা ফলিকুর ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ বার সম্পূর্ণ পাতায় ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

গাছের উপরের অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে সাধারনত বপনের ২৮০-৩০৫ দিনের মধ্যে ফলন সংগ্রহ করা যায়। ফেব্রুয়ারী মাস ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি আলগা করে হলুদের কন্দ সংগ্রহ করতে হবে তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কন্দ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কন্দের শিকড় কেটে ভালভাবে পরিস্কার করে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে । পরিষ্কার করার পর হলুদের মোথা ও ছড়া আলাদা ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। একে কিউরিং বলে। কিউরিং করে পরবর্তিতে প্রক্রিয়াজাতকরনের ব্যবস্থা করতে হবে।

উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এ জাতটি হেক্টর প্রতি ৩০-৩৩ টন ফলন দিতে পারে।

হলুদ সংরক্ষণ করতে হলে সতেজ ও রোগমুক্ত রাইজোম নির্বাচন করতে হবে। রাইজোমের আকার অনুযায়ী গর্ত খনন করে হলুদের কন্দ রাখলে সঠিক আর্দ্রতা ও সতেজতা বজায় থাকে। খড়ের চালাযুক্ত মেঝেতে ট্রেন্স তৈরী করে বালি দিয়ে তার উপর হলুদের কন্দ বিছিয়ে দিতে হবে । এরপর বিছিয়ে দেয়া কন্দের উপরে বালি দিয়ে ভালভাবে ঢেকে দিতে হবে। অবশ্যই পর‌্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

উচ্চফলনশীল বিনাহলুদ-১ চাষের বিষয়ে লিখেছেন ময়মনসিংহের বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর