লবণ আমদানিতে কারসাজি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশে খাওয়ার লবণ আমদানি নিষিদ্ধ। তবে উৎপাদন কম হলে মাঝেমধ্যে আমদানির সুযোগ দেয় সরকার। বিগত পাঁচ অর্থবছরে তিন দফা লবণ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রস্তাব করা হয়েছে তিন লাখ টন লবণ আমদানির। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে লবণ আমদানি করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে একটি মহল। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশি লবণশিল্প। কমছে চাষি, কমছে উৎপাদন।

জানা যায়, কৃত্রিম ঘাটতি দেখিয়ে লবণ আমদানি করতে পারলেই শত কোটি টাকার মুনাফা যায় আমদানিকারক সিন্ডিকেটের পকেটে। একদিকে তারা কম দামে ভারত থেকে আনা লবণ বিক্রি করে অধিক মুনাফায় পাচ্ছে, অন্যদিকে আমদানি করা বাড়তি লবণের চাপে দেশি চাষিদের উৎপাদিত লবণও স্বল্পমূল্যে হাতিয়ে নিচ্ছে।

শুধু সরকারি অনুমতি নিয়ে লবণ আমদানি নয়, চোরাইপথে লবণ আমদানির জন্যও মরিয়া একটি চক্র। তাদের মাধ্যমেও প্রতি বছর দেশে আসছে প্রচুর ভোজ্যলবণ। এই চক্র রাসায়নিক কারখানার নামে আমদানি করা লবণ সরাসরি বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। তাতেও প্রচুর মুনাফা।

সূত্র জানায়, ভারত থেকে সরকারি অনুমতি নিয়ে কেনা লবণে খরচ কেজিপ্রতি দুই টাকা। করভার কম থাকায় এমন দামের মধ্যে চীন থেকেও রাসায়নিক হিসেবে শিল্পলবণ আনা যায়। পাশাপাশি কস্টিক সোডার নামে ঝরঝরে রেডি ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন করা লবণ আসে শিল্পলবণের নামে। যা এনে বাজারে ছাড়তে পারলে লাভ হয় কয়েকগুণ।

তথ্য বলছে, বর্তমানে ভোজ্যলবণ আমদানিতে করভার ৮৯ শতাংশ, যেখানে শিল্পলবণে (কস্টিক সোডাসহ অন্যান্য) ৪৩ শতাংশ। তাই শিল্পলবণের নামে ভোজ্যলবণ আমদানি করতে পারলে অধিক মুনাফা করা সম্ভব।

অন্যদিকে মাঝে মধ্যে প্রয়োজনের অধিক লবণ আমদানির সুযোগ করে দিচ্ছে সরকারের একটি মহলও। চলতি অর্থবছরেও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিসিক তিন লাখ টন লবণ আমদানির সুপারিশ করেছিল। তখনই লবণ আমদানির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহলে। এখনো ওই লবণ আমদানির চূড়ান্ত অনুমতি দেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘শিল্প মন্ত্রণালয়ের লবণ আমদানির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে আমরা যথার্থ মনে করিনি। ফলে অনুমতি দেওয়া হয়নি।’

 

এদিকে বিসিক যখন গত মাসে লবণ আমদানির অনুমতি চেয়েছিল তখন দেশে উৎপাদিত লবণের পরিমাণ সম্পর্কে ভুল তথ্য উপস্থাপন করার অভিযোগ পাওয়া যায় মিল মালিকদের পক্ষ থেকে। তখন তারা দাবি করে, সংস্থাটি উৎপাদিত লবণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হলেও ঘাটতি দেখিয়ে আমদানির সুযোগ করে দিচ্ছে।

তবে এ বিষয়ে বিসিকের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেন, প্রয়োজনসাপেক্ষে লবণ আমদানির সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে তারা নাম প্রকাশ করে মন্তব্য দিতে রাজি হননি।

এদিকে তথ্য বলছে, দেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দুই লাখ টন, পরের বছর আড়াই লাখ টন, তারপরের বছর পাঁচ লাখ টন লবণ আমদানি করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে লবণের প্রকৃত সংকট ছিল। সে বছর লবণ আমদানি যুক্তিযুক্ত। তবে আমদানির পরিমাণ আরও কম হতে পারতো। এছাড়া অন্য বছর লবণ আমদানি ও পরিমাণ নির্ধারণে প্রভাবিত হয়েছে সরকার।

এদিকে সরকারি আমদানির মতো আরেক বড় সমস্যা অবৈধ শিল্পলবণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, দেশে ২০০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫৮ হাজার টন, পরের অর্থবছর ১১ লাখ ২১ হাজার টন এবং গত অর্থবছর ৪ লাখ ৮৯ হাজার টন শিল্পলবণ আমদানি করেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

 

শেষ অর্থবছরে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই হাজার ৭৭৭টি। এসব লবণ বেশিরভাগ শিল্পলবণ হিসেবে আনা হয়েছে। কিন্তু এসব ভুতুড়ে আমদানি ও প্রতিষ্ঠানের খোঁজ নেই কোনো সংস্থার কাছে।

এসব বিষয়ে পূবালী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক বিপুল কান্তি সাহা  বলেন, লবণ আমদানির বিষয়টি হ-য-ব-র-ল করেছে সরকার। যখন প্রয়োজন তখন বাধা দিচ্ছে। আবার প্রয়োজন ছাড়া বিভিন্নভাবে লবণ আমদানি হয়ে মিল মালিকরা পথে বসে যাচ্ছে।

‘দেশে চার-পাঁচটা বড় মিল রয়েছে। এসব মিলগুলো লবণের যে হিসাব-নিকাশ দেয়, সরকার সেটা আমলে না নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে কিছুই লাভ হয়নি। বেশিরভাগ সময়ে আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয়েছে।’

মাত্রারিক্ত শিল্পলবণ আমদানির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব লবণ আনতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে কথা বলে কতটুকু আমদানি প্রয়োজন সেটা নির্ধারণ করুক। কেন আতিমাত্রায় এনে মিল মালিকদের পথে বসানো হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আসলে এ খাতে শুধু মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান। যারা শিল্পের সঙ্গে জড়িত নয়। আর ক্ষতি হচ্ছে চাষি, মিলমালিক ও জনগণের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর