শক্ত ভিত্তি দিতেই পদ্মা ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পদ্মা ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সহায়তা দিচ্ছে সেটি বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককেও একই ধরনের সহায়তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সহায়তা ব্যাংক খাতের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনছে। তাদের মতে, নতুন আর্থিক বিবরণী তৈরি কোনো গোপন ঘটনা নয়। এ ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আদায় করে পরে সমন্বয় করা হয়। এর মাধ্যমে শক্ত ভিত্তির সুযোগ তৈরি হয় ব্যাংকের সামনে।

বিদেশি বিনিয়োগ পেতে পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী থেকে লোকসানের তথ্য গোপন করে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দিয়েছে- এমন একটি খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয় কিছু সংবাদমাধ্যমে। এ বিষয়ে ‘উদ্বেগ জানিয়ে’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বিবৃতিও দিয়েছে।

তবে বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি  বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব তো আছেই। সেটাই করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখানে ছাড়, সুবিধা বা দোষের কিছু দেখছি না আমি।’

তিনি বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক সুবিধা দিতেই পারে। কারণ ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বাইরে থেকে বিনিয়োগ এলে প্রতিষ্ঠানের ব্যালান্স শিট ভালো দেখাতে হয়। বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে দিতে পারে।

‘এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংককে সুবিধা দিয়েছে। তবে পদ্মার ব্যাংকের বিষয়টি বিরল, কারণ সেখানে তারা বিদেশি বিনিয়োগ আনছে। এ জন্য ব্যালান্স শিটে আর্থিক ক্ষতি না দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ এলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হবে। ব্যালান্স শিট ভালো দেখাবে।’

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ সুবিধা দেয়ার ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় হবে না- এমন তো নয়। এটা স্পেশাল নোটে আলাদা ব্যালান্স শিটের বাইরে থাকবে। বিদেশি বিনিয়োগ এলে ব্যাংকটি ভালো হবে; প্রতিষ্ঠানটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

‘তবে ব্যাংকটিকে এ বিনিয়োগের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে বিনিয়োগ আসার পর সেটা তদারক করা; প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আলাদা পরামর্শক দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক  বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংক বিদেশি বিনিয়োগ আনার কথা বলেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসা কল্যাণকর। বিনিয়োগ এলে ব্যালান্স শিট ভালো দেখাবে। বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য অনেক চেষ্টা করতে হয়। পদ্মা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংকটির লোকসান সমন্বয়ে ১০ বছর সময় দেয়া হয়েছে। বিনিয়োগ না এলে এ সুবিধা বাতিল হবে।’

তিনি বলেন, ‘সব আইন এবং আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং মানদণ্ড মেনেই পদ্মা ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পদ্মা ব্যাংককে কোনো ছাড় দেয়া হয়নি। ব্যাংকটির আর্থিক বিবরণী সুসংহত করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করেছে।’

টিআইবির বিবৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘যে কোনো সংস্থা যে কোনো বিষয়ে বিবৃতি দিতে পারে। এটা তাদের ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি আমার অবস্থান থেকে কোনো মন্তব্য করব না।’

ফারমার্স ব্যাংক নামে পরিচালিত হওয়ার সময় ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মের কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে। সরকারের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অফ বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধনের জোগান দেয়। ফলে ‘পদ্মা ব্যাংক’ নামে প্রতিষ্ঠানটির নতুন যাত্রায় মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশই এখন সরকারি ব্যাংকের হাতে।

ফারমার্স থেকে নাম পরিবর্তন করে পদ্মা নামে কাজ শুরুর চার বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি অনেক কমেছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদ্মা ব্যাংককে যে সহায়তা করছে, সেটা বাংলাদেশে নতুন নয়। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিকে বড় ধরনের সংকটে পড়ে তখনকার ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে এতে প্রশাসক বসায়। তবে তারল্যসংকটের কারণে ব্যাংকটি ওই সময় আমানতকারীদের টাকা দিতে পারছিল না।

সরকার এরপর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে সাড়ে ৬ বছর সময় দিয়ে ২০০৭ সালে একটি স্কিম বা কর্মসূচি চালু করে। এ ছাড়া ব্যাংকটির বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রির জন্য নিলাম ডাকা হয়। নিলামে অংশ নিয়ে ওই শেয়ার কিনে নেয় আইসিবি ফিন্যানশিয়াল গ্রুপ এজি এবং ২০০৮ সালে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামে প্রতিষ্ঠানটির নতুন যাত্রা শুরু হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র  বলেন, ‘ওই সময়েও ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একইভাবে পদ্মা ব্যাংকেও বিদেশি বিনিয়োগ আনতে সহায়তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিধিবিধান, আইন-কানুনের মধ্যে থেকেই এই সহায়তা করা হচ্ছে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বের একটি অংশ।’

পদ্মা ব্যাংকের সবশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফারমার্স থেকে ‘পদ্মা’ নাম নিয়ে কার্যক্রম শুরুর পর ২০১৮ সালে ব্যাংকটিতে আমানত ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। ব্যাংকটির ঋণ দেয়ার কোনো অনুমোদন ছিল না। ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকাই ছিল মন্দমানের শ্রেণীকৃত ঋণ।

তবে ২০২০ সালের জুনের পর ঋণ দেয়ার অনুমতি মেলে। ফারমার্সের সময় যে চার হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ ছিল, সেখানেও কোনো আয় ছিল না। এটা আরও ভঙ্গুর ব্যাংকে রূপান্তর হওয়ার কথা ছিল। তবে এখন দক্ষ ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী ব্যাংকে রূপান্তর হওয়ার দিকে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।

ফারমার্সের সময়ে ৮০ শতাংশ খেলাপি ঋণ ছিল, সেটা কমে ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। আমানত-ঋণের অনুপাত আগে ছিল ১১৮ শতাংশ। এখন সেটা কমে হয়েছে ৯২ শতাংশ।

এ ছাড়া মূলধন ৪০০ কোটি থেকে বেড়ে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে ৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে আমানত রয়েছে পদ্মা ব্যাংকে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর