টাইগার গণি বাঘের মুখ থেকে মানুষ ছিনিয়ে আনেন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামে বাস আব্দুল গণি গাজীর। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। পেশায় বনজীবী। বর্তমানে সবাই তাকে চেনেন ‘টাইগার গণি’ নামে।

জীবিকার তাগিতে সুন্দরবনে যাওয়া জেলে বাওয়ালিদের কেউ বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে নিহত বা আহত হলে তাদেরকে বাঘের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনেন টাইগার গণি। এজন্যই আব্দুল গণি গাজী এখন টাইগার গণি নামে পরিচিত। তবে এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেন না গণি। স্বেচ্ছাশ্রমেই কাজটি করেন তিনি।

একটি বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ওয়াইল্ড টিমের ফরেস্ট টাইগার রেসপনস টিমে চাকরি করতেন গণি। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাঘের মুখ থেকে অর্ধ-শতাধিক মানুষকে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।

টাইগার গণি নামের বিষয়ে জানতে বিস্তারিত কথা হয় আব্দুল গণি গাজীর সঙ্গে। এ সময় তিনি বলেন, ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে সুন্দরবনের নদী খালে মাছ ধরতে যেতাম। স্থানীয় সহযোগী হিসেবে ২০০৭ সালে বন বিভাগকে সহযোগিতা করতে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক গঠিত ওয়াইল্ড টিমে আমার কাজ করার সুযোগ হয়। ওই সময় আমার এলাকার একজন মৌয়াল বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। আমি সেই মরদেহটি উদ্ধার করতে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের সহযোগিতা করি। পরবর্তীতে ফরেস্ট টাইগার রেসপনস টিমের টিম লিডারের দায়িত্ব পাই।

 

এরপর টানা ১২ বছর ওয়াইল্ড টিমের সঙ্গে থেকে সুন্দরবনে কেউ বাঘের আক্রমণের শিকার হলে আমি তাদের উদ্ধার করে আনি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি ৭০টিরও বেশি মৃতদেহ বাঘের কাছ থেকে উদ্ধার করে এনেছি। এছাড়া কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ওয়াইল্ড টিমের ফরেস্ট রেসপনস টিমের প্রোজেক্টের মেয়াদ শেষ হলেও আমার কাজ অব্যাহত রয়েছে। যখনই খবর আসে কোনো মানুষকে বাঘে ধরেছে আমি সঙ্গে সঙ্গে বনে ছুটে যাই। সবশেষ গত মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) বাঘের আক্রমণে নিহত বনজীবী মুজিবর রহমানের মরদেহটিও আমি উদ্ধার করে এনেছি।

তিনি বলেন, সোমবার বিকেলে মুজিবর রহমানকে সুন্দরবনের পায়রা টুনি খাল থেকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে রেসকিউ টিমের সঙ্গে আমিও বনে যাই। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর বাঘের পায়ের ছাপ ও রক্তের দাগ দেখে বনের গভীর থেকে মুজিবর রহমানের মৃতদেহটি উদ্ধার করে আনি। এই অল্প সময়ে বাঘটি মৃতদেহটির একটি পা পুরোটাই খেয়ে ফেলে। মৃতদেহটি উদ্ধার করে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি, এটুকুই আমার তৃপ্তি।

আব্দুল গণি গাজী বলেন, মা বাবা মারা গিয়েছেন। পরিবারে আমিসহ স্ত্রী, এক ছেলে ও পাগল (মানসিক ভারসাম্যহীন) এক বোন রয়েছে। একটি মেয়ে তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। ছেলে গতবার এইচএসসি পাস করেছে। চাকরি যাওয়ার পর মাঝে মাঝে বনে মাছ ধরতে যেতাম। ছোট একটি ব্যবসাও শুরু করেছিলাম। তবে লোকসানে পড়ে বর্তমানে আমি বেকার রয়েছি। যদি কোনো সংস্থায় কাজের সুযোগ পাই, সেই অপেক্ষায় আছি। তবে বর্তমানে বাঘ নিয়ে সুন্দরবনে কোনো প্রজেক্ট চলছে না।

 

এ বিষয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটি সাতক্ষীরার আহ্ববায়ক গাজী সালাউদ্দিন বাপ্পি বলেন, গণি খুব ভালো মানুষ, সুন্দরবনে কাউকে বাঘে ধরেছে শুনলেই স্বেচ্ছায় উদ্ধার কাজে অংশ নেন তিনি। স্থানীয়রা তাকে এই সাহসী কাজের জন্য শ্রদ্ধা করে। চাকরি না থাকায় বর্তমানে অর্থকষ্টে দিন কাটছে তার। এরপরও মানুষের বিপদে এগিয়ে আসেন তিনি। সরকারিভাবে এই সাহসী মানুষটিকে সম্মানিত করার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান তিনি।

পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) কর্মকর্তা এম এ হাসান  বলেন, টাইগার গণি এক সময় একটি বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ওয়াইল্ড টিমের সঙ্গে কাজ করতেন। তখন থেকে কেউ বাঘের আক্রমণের শিকার হলে তাকে উদ্ধার করতেন গণি। সেসময় ওয়াইল্ড টিম ও বন বিভাগ থেকে তাকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে আমাদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।

তবে কয়েকদিন আগে বাঘের আক্রমণে নিহত মুজিবরকে উদ্ধার অভিযানে রেসকিউ টিমের সঙ্গে আব্দুল গণি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিলেন। সুন্দরবনে বর্তমানে ওয়াইল্ড টিমের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ হলে টাইগার গণির জন্য কাজের ব্যবস্থা করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর