বনাঞ্চল দখলের কারণে লোকালয়ে হাতির আক্রমণ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ শেরপুরের সীমান্ত ঘেঁষা তিনটি উপজেলার বনাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে নেমে আসা শতাধিক বন্যহাতি বসবাস করে আসছে। তাই বন্যহাতির সুরক্ষায় ওই এলাকায় অভয়ারণ্য তৈরি করেছে সরকার। কিন্তু স্থানীয়রা আস্তে আস্তে জায়গা দখলে নেয়ায় বনাঞ্চলটি সংকুচিত হয়ে গেছে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে হাতির দল খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, জীবিকার আর কোনো উপায় না থাকায় তারা বনের জমিতে চাষাবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ নিয়ে বন কর্মকর্তারা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের বনের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য নেয়া হচ্ছে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

এর আগে বন বিভাগসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল হাতি সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা করতে ভারতের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। একই কারণে ভারতের কর্মকর্তারাও এদেশে এসেছেন। কিন্তু লোকবলের অভাবে সেই অভিজ্ঞতা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে জানান বন কর্মকর্তারা।

তারা জানান, স্থানীয় জনসাধারণের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৬ সালে লোকালয়ে হাতির হামলা ঠেকাতে ঝিনাইগাতী উপজেলার তাওয়াকুচা এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সোলার ফ্যান্সিং (বৈদ্যুতিক বেড়া) এর পাইলট (পরীক্ষামূলক) প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কিন্তু ওইসব এলাকার মানুষজন বনের ভিতর হাজার হাজার গরু চড়িয়ে সোলার ফ্যান্সিংগুলো ধ্বংস করে ফেলেছে।

তারা আরও জানান, এলাকাবাসীর জানমাল ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা মাথায় রেখে আবারও নতুন করে শ্রীবরদীর রাঙ্গাজান, খ্রিস্টানপাড়া ও বালিজুড়ি এলাকায় ৮ কিলোমিটার জুড়ে সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নষ্ট হয়ে যাওয়া সোলার ফ্যান্সিংগুলো মেরামতের জন্য বাজেট চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া হাতিকে বনে রাখার জন্য সরকারের সুফল প্রকল্পের আওতায় বিপুল পরিমাণ ওষুধি, ফলমূল ও কাঠগাছ রোপণ করা হচ্ছে। এখন জনসাধারণকে বনের জ্বালানি কাঠ ও আগাছাও কাটতে দেয়া হচ্ছেনা। এর ফলে ওই এলাকা আরো গহীণ বনে পরিণত হবে।

সেখানে থাকবে ফুড ফেস্টার বাগান (তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ), বাঁশ, কলা, কাঁশফুলের বাগান, আমলকি, হরতকি, বহেড়া ও চাপালি জাতীয় গাছ। এক সময় বনে আর হাতির খাবারের অভাব হবে না। পাশাপাশি হাতির খাবারের সংস্থান আরো স্থায়ী রুপ দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।

 

শেরপুরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার দেয়া তথ্যমতে, ১৯৯৫ সাল থেকে বন্যহাতির আক্রমণে এ পর্যন্ত জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় ৯০ জন মারা গেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। অন্যদিকে নানা কারণে ২৫-৩০টি বন্য হাতির মৃত্যুও হয়েছে। এ পর্যন্ত বন্য হাতির আক্রমণে শত শত ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সহস্রাধিক একর জমির ফসল, সবজি ক্ষেত ও ফল বাগান নষ্ট হয়েছে।

ঝিনাইগাতীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হক বলেন, ‘সরকার সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তা রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য আলাদা কোনো লোকবল নিয়োগ করেনি। অন্যদিকে জেলা বন বিভাগেও রয়েছে কর্মীর অভাব। যে কারণে ওই প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে সফলতা বয়ে আনলেও তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।’

শ্রীবরদীর বালিঝুড়ির ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জা কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বন্য হাতির দল অতি সম্প্রতি সোনাঝুড়ি এলাকায় হামলা চালিয়ে সবজি বাগান খেয়ে সাবার করে দিয়েছে। এ কারণে সেখানকার মানুষ হাতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। লোকবল কম থাকায় হাতি-মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা এখন কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে।’

শেরপুর থেকে সদ্য বিদায়ী সহকারি বন-সংরক্ষক প্রাণতোষ রায় বলেন, ‘যারা প্রতিনিয়ত বন থেকে লানী কাঠ, পাথর ও বালি নিচ্ছেন তাদের এই নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ জন্য বন এলাকার তিন কিলোমিটারে বসবাসকারিদের নিয়ে জরিপ করা হচ্ছে। এদের মধ্যে অতিদরিদ্র, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত এই চারটি ভাগে বিভক্ত করা হচ্ছে। এরমধ্যে কারা অতিমাত্রায় বনের উপর নির্ভরশীল তাদের চিহিৃত করা হচ্ছে।’

তিনি জানান, চিহিৃত ব্যক্তিরা যেন আর বনে না যায় এরজন্য তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। ওইসব ব্যক্তিরা যদি মুদি দোকান, কম্পিউটার, মুরগী পালন, হাঁস পালন, আটোরিকশা বা ভ্যানগাড়ির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতে চান তাহলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার পূঁজি দেয়া হবে। আগামী ডিসেম্বর থেকে এ সহায়তা দেয়া শুরু হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সারা দেশের বনাঞ্চল এলাকার প্রায় ৪০ হাজার পরিবার এই সুবিধা পাবেন। এর মধ্যে শেরপুরের সীমান্ত এলাকার প্রায় ৭শ’ পরিবার এ প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত হবেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর