বিভেদ দ্রুত ছড়াতে বারবার ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশে বিভেদ দ্রুত ছড়াতে বারবার পবিত্র কোরআন ও ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার মূলেও পরিকল্পিতভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছে একটি মহল। আর কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়া এটা হতে পারে না।

সাম্প্রদায়িক হামলা রুখতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসার পরামর্শ  দেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির-মন্ডপ, হিন্দুদের ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৭০ মামলা হয়েছে।

কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মামলায় আসামি হয়েছেন ১০ সহস্রাধিক। গতকাল গ্রেফতার হয়েছেন ২৬৩ জন। এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলায় এ পর্যন্ত ১৬ জেলায় পাঁচ শতাধিক গ্রেফতার হলেন।

দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার দায় কেউ এড়াতে পারেন না। প্রতিটি পূজামন্ডপে নিজস্ব পোশাকধারী পাহারাদার, মন্ডপের চাহিদা অনুযায়ী ৫ থেকে ২০ জন অস্ত্রধারী আনছার সদস্য থাকার কথা ছিল। এছাড়া মন্ডপগুলোতে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার নির্দেশনাও ছিল না। কিন্তু কুমিল্লার সেই পূজামন্ডপে এসব কোন নির্দেশনাই মানা হয়নি। একজন পাহারাদার থাকলেও তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। সিসি ক্যামেরা না থাকার পাশাপাশি অস্ত্রধারী কোন আনসার সদস্য ছিল না।

এখন কুমিল্লার ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনার দায় নেবে কে? পূজামন্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্ব স্ব থানা এলাকায় পুলিশ, র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল দেওয়ার কথা ছিল। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল। কিন্তু তারপরও কেন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলো-এই প্রশ্ন এখন সবার।

প্রসঙ্গত, গত ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার অষ্টমীতে কুমিল্লার একটি মন্দিরে কথিত ‘কোরআন অবমাননার’ অভিযোগ তুলে কয়েকটি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর চালানো হয়। এরপর গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০টি পূজামন্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ তথ্য দিয়েছে।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনাটি পরিকল্পিত। ঘটনার দিন ভোরে ওই মন্দিরে যে দুই জন গেছে, তারা কারা? এটা দেখার বিষয়। এই ঘটনায় পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মেজর ফেইলর বলা যাবে না। তবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সবার সতর্ক থাকতে হবে।’

সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি রামুতে গুজব রটিয়ে তান্ডব চালানো হয়েছিল। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন গুজব রটিয়ে বগুড়া, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন স্থানে জ্বালাও-পোড়াওসহ তান্ডব চালায়। কুমিল্লায় পূজামন্ডপের ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে দ্রুত বিশৃঙ্খলা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এ কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে কুমিল্লায়। তিনি বলেন, শুধু পুলিশকে দায়ী করলে হবে না। এলাকার জনগণ ও জনপ্রতিনিধিরাও আছেন। তবে পুলিশকে জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের এলার্ট থাকতে হবে। সবাই সজাগ থাকলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।’ জনগণকে সম্পৃক্ত করে সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, রাজনীতি কিংবা ধর্ম যে কারণেই হোক না কেন, পরিকল্পিতভাবে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। তবে এটার পেছনে রাজনীতি আছে। রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া এটা করা সম্ভব না। স্থানীয় প্রশাসনকে আরো সক্রিয় হওয়া উচিত। এই ধরনের বিভেদ দ্রুত ছড়াতে সব সময় ধর্ম ও পবিত্র কোরআনকে বেছে নেওয়া হয়। এতে সংঘাত দ্রুত ছড়ায়। সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিরোধে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মিছিল-সমাবেশ করে জনগণকে বোঝাতে হবে, নিরীহ মানুষের ওপর হামলা কেন? তাদের অপরাধ কী?

কুমিল্লায় পূজামন্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখে অবমাননায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টি, সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা চালানোর মূল হোতা, নেপথ্য নায়কসহ দুষ্কৃতকারীদেরকে ধরতে ঢাকা থেকে আসা সোয়াত, অ্যান্টি টেরোরিজম, পুলিশ ইণ্টারন্যাল অর্গানাইজেশন (পিআইও), জেলা পুলিশ-ডিবি, সিআইডি, র‌্যাব, পিবিআইসহ পুলিশের সকল ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কুমিল্লায় কাজ করছে।

জানা গেছে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় সোমবার পর্যন্ত জেলার কোতয়ালি মডেল থানায় ৫টি, সদর দক্ষিণ মডেল থানায় ২টি ও দাউদকান্দি মডেল থানায় ১টিসহ ৮টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। এসব মামলায় ৭৯২ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) তিন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যথাক্রমে গোলাম কিবরিয়া, মোশারফ হোসেন, ইকরাম হোসেন বাবুসহ ৯২ জনের নাম এজাহারে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে, অন্যরা অজ্ঞাতনামা আসামি।No description available.

এর মধ্যে ঘটনার পর পর ফেসবুকে লাইভসহ ভিডিও-ছবি তুলে ভাইরাল করে জনমনে উত্তেজনা সৃষ্টির ঘটনায় পুলিশ ফয়েজ নামে একজন ও র‌্যাব গোলাম মাওলা নামে এক ভিডিও এক্সপার্টকে গ্রেফতার করে। এ দুইজনের বিরুদ্ধে পুলিশ ও র‌্যাব বাদী হয়ে পৃথকভাবে কোতয়ালি মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় ৪৩ জন আসামি বর্তমানে কুমিল্লা কারাগারে আছে।

এদের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের দায়ের করা মামলার একমাত্র আসামি জেলার আদর্শ সদর উপজেলার রঘুরামপুর গ্রামের মৃত আবদুল করিমের ছেলে মো. ফয়েজকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই হারুনুর রশিদ আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।

ফেনীতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে’র ঘটনায় দুই মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪ শতাধিক আসামি করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব সদস্যরা আহনাফ তৌসিফ মাহমুদ লাব্বি (২২) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে।

এদিকে সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক আদেশে পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবীকে বদলি করা হয়। একই দিন দুপুরে সহিংসতার স্থান পরিদর্শন করেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফেনী মডেল থানায় দায়ের করা একটি মামলায় ২০০ থেকে ২৫০ জন এবং অন্য একটি মামলায় ১০০ থেকে ১৫০ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। নগরের জেএম সেন হলের পূজামন্ডপে হামলার চেষ্টা ও ব্যানার-পোস্টার ছেঁড়াসহ পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে আটক ১০ জনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমানের আদালত।

আটক এই ১০ জন হলেন-ইমরান মাজেদ রাহুল, মো. হানিফ, আব্দুর রহিম, এসএম ইউসুফ, আমিরুল ইসলাম, মো. সালাউদ্দীন, আতিকুল ইসলাম, মো. শহীদ, মো. শাহাজাহান ও আব্দুল মালেক প্রকাশ মানিক।

উল্লেখ্য, গত শনিবার সকালে কোতোয়ালী থানার এসআই আকাশ মাহমুদ ফরিদ বাদী হয়ে ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত চার-পাঁচশ’ জনকে আসামি করে মামলা করেন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ৮৩ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায় কোতোয়ালী থানা পুলিশ। আসামিদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। নাটোরের লালপুর উপজেলার জোতদৈবকী গ্রামে শীতলা পূজার মাথা বিচ্ছিন্ন করে অন্যত্র ফেলে রাখা সহ ভেঙে ফেলা হয়েছে পূজার হাতের আঙ্গুল। রবিবার রাতের কোন এক সময় দুস্কৃতকারীরা এঘটনা ঘটায় বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। লালপুর থানার ওসি ফজলুর রহমান জানান, ঘটনার সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।

লামায় পুলিশ ও পূঁজামন্ডপে হামলা, সনাতন ধর্মানুসারীদের দোকান ভাংচুর, লুটপাট এবং পুলিশীকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক মেয়র প্রার্থী মো. শাহীনসহ প্রায় ৭০০ জনের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর