আমার ছোটবেলা ও আমার গাঁ

খান লিটন, জার্মানি থেকেঃ  আপনি যদি বাংলাদেশের ভেনিস বরিশাল পর্যন্ত যে কোনো পথে যান, সেখান থেকে আপনাকে আমি সরিষামুরী নিয়ে যাব। বরিশাল থেকে তিনটি খরস্রোতা নদী- আগুনমুখা, পায়রা, বিশখালী একেঁবেকেঁ সাগরে প্রবাহিত হয়।

স্বাভাবিক ভাটার গতিতে সাগরকে তার জলের শোধ দিলেও সাগর মাঝে মধ্যে তেড়ে আসে তার জলরাশি নিয়ে, ভাসিয়ে নেয় উপকূলবাসীকে। এক সময় কাঠের দোতালা (ঢাকা থেকে আসা), দেড়তালা বা একতালা লঞ্চই ছিল এই ভাঁটির জনপদের চলাচলের বাহন ও নৌকা। আজকাল ইটের পিচঢালা পথে কিংবা হেলিকপ্টারেও যাওয়া যায় । ফুলঝুরি হলো লঞ্চঘাট । হ্যাঁ, সরিষামুরী সত্যিকারের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা একটি গ্রাম। যার পাশ দিয়ে বয়ে যায় অবিরত বিশখালী নদী। বরগুনা জেলার (সাবেক মহকুমা) বেতাগী উপজেলা বা থানার ৭নং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড।

এখানে আমি অর্ধশতাব্দির একটু বেশি সময় আগে মরহুম আলী খাঁ (হজরত আলী খান) মরহুমা জরীর (জরিনা আলী খান) দোতলা টিনের নাকবারান্দা দেয়া ঘরে এসেছিলাম এই ধরনীতে। ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, হাঁস-মুরগির সমাহার। ছিল মমতাময় জীবন। সব ভাইবোনদের পরে আগমনে, বড় ভাইবোনদের স্নেহে বড় হয়েছি। বোনরা নাকি ছোটবেলায় ওড়নায় জড়িয়ে মক্তবে নিয়ে যেত। এই গ্রামে বড় হয়েছি, বাবা চাচার জমিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কৃষ্ণ স্যারের (পরলোকগত) কাছে তালপাতায় ও পরে শ্লেট-পেন্সিল দিয়ে বর্ণমালা শিখেছি। ফুলঝুরি বাজারে গিয়ে বারৈর দোকান থেকে বাতাসা, সন্দেশ ও জিলাপি নিয়ে আসতাম, ছোটদের কাছে টাকা চাইতো না। ঝড়ে সেই স্কুল প্রায়ই উড়ে যেতে দেখেছি, যা আজ তিনতলা ইটের ইমারত।

এখানে মনু (ব্যবসায়ী), পান্না (অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা), জাহাঙ্গীরসহ (বরিশাল দপদপিয়া খেয়াঘাটের মাঝি) গ্রামের দুষ্ট ছেলেদের সাথে মেশা নিষেধ থাকা সত্ত্বেও পালিয়ে গ্রাম্যখেলা খেলেছি। যেমন- ডাংগুলী, হাডুডু, ছোঁয়াছুঁই, মার্বেল, অকারণে ডুবাডুবি (সাঁতার), ফুটবল না থাকার কারণে ছোলম (জাম্বুরা) দিয়ে ফুটবল।

জোৎস্না রাতে নিজেদের নারিকেল বা রস চুরি করে রাতে পায়েশ বা শিন্নি খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। বড়ভাই মরহুম এমএ সাত্তার খান ছুটিতে গ্রামে এলে নতুন জামা, ইংলিশ প্যান্ট পরা, বাটার জুতা যা নারিকেল তেল দিয়ে রোদে শুকাতাম ও নতুন কচকচা এক টাকা পাওয়ার মজাই ছিল অন্যরকম । গেদা মাঝির এক মালাই নৌকায় ভাঁটা জোয়ারের সাথে তাল রেখে অনেক সময় পাল তুলে চৌদ্দবত্তনিয়া মামুবাড়ি ও গুলিশাখালী বোনের বাড়ি যাওয়া ছিল আকর্ষণীয়। এই গ্রামে ঝাঁকি জাল দিয়ে নদীতে বা কোলায় (বৃষ্টির সময় মাঠে) চড়া দিয়ে (আগে মাটি ও চালের ভুষি মিশিয়ে) মাছ ধরেছি ।

অমূল্য মা কাকিরে ধান দিয়ে মুড়ি বা মোয়া খেয়েছি। এখানে বাবা ও মেজোভাইকে তরমুজ ও আখক্ষেত দিয়ে পাইকারি (ফইরার নাও) বেঁচতে দেখেছি। শীতে ওয়াজ মাহফিল হলেও যুবকরা নাটকও করেছে । এখানে দেখেছি হাঁটু সমান কাঁদার রাস্তায় হাঁড়িপাতিল বিক্রিওয়ালাদের আওয়াজ ও অগ্রহায়ণে নবান্নের আমেজে ব্যাবাইজ্জার (বাইদানী বা সাপুড়ে) আওয়াজ- “শিংগা লইবেন? শিংগা লইবেন“? নির্মল ও আজিজ পেয়াদা (আমার চাচাতো দুলাভাই) মন ভুলানো বাঁশের বাঁশি বাজাতো রাতে। এখানে দেখেছি, অন্তা, অনন্ত কুমার শীল (পারিবারিক নাপিত) মাসে একবার এসে তার পূর্বপূরুষের দাঁতবিহীন মেশিন দিয়ে হাঁটুর নিচে আমাদের ঘাড় চেঁপে ধরে মাসে একবার চুল কেটে দিতেন। মেশিন পুরনো হওয়ার কারণে ঘাড় জ্বলার পাশাপাশি বিরক্তিকর ছিল।

হাঁটের দিন বুধবার ও রোববার মায়ের বেশি ব্যস্ততা, বারবার পুকুর পাড়ে গিয়ে রাস্তায় তাকানো, তার ভাই আজিজ হাওলাদার বা ছোট মামু শাহেদ হাওলাদার আসতে পারে তাই। গ্রামে ছোট-বড় সমস্যা প্রায়ই গ্রামের বাঙ্গা ভাই বা খাঁ সাব ও বাঙ্গা ভাউজ (আমার মা) মিটিয়ে দিতেন। আমার পুরো মনে নেই, শুনেছি- মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাবার হিন্দু বন্ধুরা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেখেছি ঈদে তারা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন, আমরা পুজোয় তাদের বাড়িতে গিয়েছি। অনেকে সন্ধ্যাবেলা পুঁথি পড়তো, আমার মেজোভাই মরহুম জয়নাল আবেদিন খানও পড়তেন। আরও হাজারও ঘটনা, হাজারও কথা। আজ অনেক কিছুই নাই, চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন আমার পূর্বপুরুষরা, মা-বাবাসহ বড়ভাই, মেজোভাই এই সরিষামুরী গ্রামে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর