হাওর বার্তা ডেস্কঃ কোনো জাতি তার আভিজাত্য ও অস্তিত্ব রক্ষায় যোগ্যতার পরিচয় তখন দিতে পারে, যখন তার জীবনের নানা ধারায় ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রতিভাবান ও মেধাবী মানুষের আবির্ভাব ঘটে। ভারতবর্ষের মুসলিমরাও তাদের জীবনধারার প্রায় সব শাখায় বিরল প্রতিভাবান ও মেধাবী মানুষের সাক্ষাত্ লাভ করেছে। সাধারণ জ্ঞানী-গুণীদের পাশাপাশি মুসলিম শাসকরাও জ্ঞানসাধনায় মনোযোগী হন। যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ধারায় যোগ্যতা ও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

জ্ঞানী-গুণীদের ভারতে আশ্রয় : মোঙ্গলীয় তাতাররা প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে অভিযান চালানোর পর মুসলিম বিশ্বে সীমাহীন বিপর্যয় ও বিপদ নেমে আসে। ইসলামী সভ্যতা, মুসলিম বিশ্বের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জ্ঞানকেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত শহরগুলোতে দেশত্যাগ ও দেশান্তরের শক্তিশালী ঢেউ ওঠে। তখন ভারতবর্ষ শাসন করছিল তুর্কি বংশোদ্ভূতদের দাসরা। প্রাচ্যে ভারতই একমাত্র দেশ ছিল, যারা তাতার ও মোগলদের প্রতিহত করতে পেরেছিল এবং বারবার তাদের হামলা প্রতিহত করে। ফলে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে পারস্য (ইরান) ও তুর্কিস্তানের (মধ্য এশিয়া) অভিজাত, মেধাবী ও নেতৃস্থানীয় ধর্মীয় ব্যক্তি-পরিবারগুলো ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং স্থায়ীভাবে তারা ভারতে বসবাস শুরু করে। শামসুদ্দিন ইলতুিমস, গিয়াস উদ্দিন বলবন, আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে ভারতে জ্ঞান, গুণী ও পণ্ডিতদের আগমন সবচেয়ে বেশি হয়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসবেত্তা জিয়াউদ্দিন আল-বেরুনি তাদের আগমনের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এসব পরিবার, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, নেতৃবৃন্দ, প্রতিভাবান আলেমরা দেশত্যাগ করেছিলেন অভিশপ্ত চেঙ্গিস খানের অভিজানের কারণে। তাদের মধ্যে ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা, বড় পণ্ডিত, বিচারক, ধর্মীয় তথা আলেম, পীর-মাশায়েখরা ছিলেন।’ (তারিখে ফিরোজশাহী, গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনকাল)

ভারতের কয়েকজন জ্ঞানসাধক

মুসলিম শাসক

ভারতবর্ষের মুসলিম সম্রাট, আমির, মন্ত্রী ও সেনাপতিদের মধ্যে যারা জ্ঞানসাধনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো—

সম্রাট আলমগীর : যারা সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের জীবনী পাঠ করেছেন, যাঁরা জানেন তাঁর জ্ঞান ও আমলের বৃত্তান্ত, তাঁর কীর্তিমান ইতিহাস, ৫০ বছরের দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রাম ও জিহাদের কথা, বড় বড় বিজয় ও সংস্কারের বর্ণনা, সংযম ও কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা, দৃঢ়তা ও মনোবলের উচ্চতা এবং শেষ জীবনে ঋণে জর্জরিত হওয়ার করুণ কাহিনি, যারা অবগত হয়েছে তাঁর সময়ানুবর্তী জীবন, সুবিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব সুনিপুণভাবে পালনের পরও ফরজ ও সুন্নতের সংরক্ষণ, ইবাদত, জ্ঞানচর্চা ও অধ্যয়নের ব্যাপারে তারা বিশ্বাস করেন যে পৃথিবীর রাজা-বাদশাহদের ইতিহাসে এত সত্সাহসী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব বিরল। তাঁর মতো লৌহমানবের দৃষ্টান্ত ইতিহাসের কোনো যুগে, কোনো অঞ্চলে মেলা কঠিন।

মুজাফফর হালিম : ভারতীয় মুসলিম শাসকদের মধ্যে মুজাফফর হালিম (মৃত্যু ৯৩২ হি.) গুজরাটির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি একই সঙ্গে ন্যায়পরায়ণ শাসক, মুহাদ্দিস ও ফকিহ ছিলেন। তিনি মৃত্যুর সময় আল্লাহর এই অনুগ্রহের কথা বলতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ‘আমি আমার শিক্ষক মহান আলেম মাজদুদ্দিন থেকে কোনো হাদিস, যা তিনি তাঁর শিক্ষকদের থেকে বর্ণনা করেছেন তা বর্ণনা করিনি, যতক্ষণ না আমি তা মুখস্থ করেছি, তার সূত্রগুলো জেনেছি; বর্ণনাকারীর হাদিসচর্চা, গ্রহণযোগ্যতা, পুরো জীবন সম্পর্কে অবগত হয়েছি। আল্লাহ আমাকে প্রতিটি আয়াত মুখস্থ করা, তার ব্যাখ্যা বোঝা এবং অবতীর্ণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত, কিরাত সম্পর্কিত জ্ঞানগুলো জানার তাওফিক দান করেছেন। আর ফিকহের ব্যাপারে আমি নিম্নোক্ত হাদিসের সুসংবাদ লাভের আশা করি—আল্লাহ যার কল্যাণ চান তিনি তাকে ধর্মের গভীর জ্ঞান দান করেন। আমি আমার জীবনের কয়েক মাস তাসাউফের সাধনায় কাটিয়েছি। আমি তাফসির গ্রন্থ ‘মাআলিমুত-তানজিল’ অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম। প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। আমি আশা করি, জান্নাতে তা শেষ করতে পারব। ইনশাআল্লাহ! (বিস্তারিত জীবনী জানতে : নুজহাতুল খাওয়াতির, চতুর্থ খণ্ড)

ইমাদুদ্দিন গিলানি : রাজা-বাদশাহদের পর যদি আমরা মন্ত্রীদের প্রতি মনোযোগ দিই তবে মন্ত্রী ইমাদুদ্দিন গিলানি (মৃত্যু ৮৮৬ হিজরি) যিনি মাহমুদ গাওয়ান নামেও পরিচিত ছিলেন। প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও পণ্ডিত এই মন্ত্রী ছিলেন ধর্মীয় ও জাগতিক নেতৃত্বের মোহনা। তাঁর সুখ্যাতি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। প্রাশাসনিক ব্যবস্থাপনা, অধিক ইবাদত, পূর্ণ আল্লাহভীতি, জ্ঞানে পাণ্ডিত্ব, আলংকরিক ভাষা ও শিল্প কর্মে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব। বিখ্যাত সুফি কবি আবদুর রহমান জামি (রহ.) তাঁর প্রশংসায় আবৃতি করেন—‘বিত্তশালীদের নেতা তিনি, অভাবীদের অলংকার। তাঁর মধ্যে দারিদ্র্যের চিহ্ন বিদ্যমান বটে, তবে তা ধনাঢ্যের চাদরে আবৃত।’

আবদুল আজিজ গুজরাটি : মন্ত্রী আবুল কাসিম আবদুল আজিজ গুজরাটি (মৃত্যু ৯৬১ হি.)—যিনি আসাফ খান নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি উসুলে ফিকহের (ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি) পণ্ডিত ও মর্যাদাশীল মুহাদ্দিস ছিলেন। হেজাজের বিশিষ্ট আলেম শিহাবুদ্দিন বিন হাজর তাঁকে নিয়ে স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেছেন। যেখানে তিনি আল্লামা আসাফ খান (রহ.)-এর জ্ঞানগত মর্যাদা, চারিত্রিক মাধুর্য, ইবাদতে নিমগ্নতা, দ্বিনি কাজে দৃঢ়তা, আল্লাহভীতি অবলম্বনে সর্বোচ্চ সতর্কতা, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় অবিচলতা, জ্ঞানচর্চা ও আলেমদের পৃষ্ঠপোষকতার এমন নানাদিক তুলে ধরেছেন যা সত্যিই বিস্ময়কর। আরবের কবিরা তাঁর প্রশংসায় কবিতা রচনা করেছেন এবং তাঁর মৃত্যুতে মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেছেন। (বিস্তারিত দেখুন : নুজহাতুল খাওয়াতির, চতুর্থ খণ্ড)

বৈরাম খান : তাদের অন্যতম কবি, সাহিত্যিক, সাহসী বীর ও সুদক্ষ সেনাপতি আবদুর রহিম বৈরাম খান দেহলভি (মৃত্যু ১০০৫ হি.)। সর্বকালের সেরা মোগল সেনা নায়কদের অন্যতম বৈরাম খানের এক হাতে ছিল কলম আর অন্য হাতে ছিল তরতারি। ভারতবর্ষের নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিকরা তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, ‘তাঁর মেধা ও প্রতিভা, উচ্চ মানসিকতা ও সত্সাহস, উদারতা ও দানশীলতার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক, অধ্যয়ন; বিশেষত ইতিহাস গ্রন্থের প্রতি তাঁর অনুরাগ, জ্ঞানী-গুণীদের প্রতি ভালোবাসা এবং নিচু ও হীনদের সঙ্গে দূরত্ব, ব্যক্তিগত জীবনের পরিচ্ছন্নতা, ভালো কাজের আগ্রহের ক্ষেত্রে তাঁর আগে ও পরের (শাসক ও মন্ত্রীদের ভেতর) এমন কাউকে পাওয়া যায় না, যাকে তাঁর সমকক্ষ বলা যায়। (নুজহাতুল খাওয়াতির : ৫/৩১৭)

আবদুর রাজ্জাক খাওয়াফি ‘মাআসিরুল উমারা’ নামক গ্রন্থে লেখেন, ‘তাঁর যুগে সাহসিকতা ও উদারতায় তিনি অদ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আরবি, ফার্সি, হিন্দিসহ বহু ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি এসব ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং তার ভাষা ছিল সাহিত্যমান উত্তীর্ণ ও অলংকারপূর্ণ। তিনি এসব ভাষায় মানোত্তীর্ণ ভাষায় কথা বলতেন।’

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর