উজানের পানিতে উত্তর ও মধ্যাঞ্চল প্লাবিত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রবল বেগে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারের পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের নদ-নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে বানভাসি মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন।

বন্যায় বসতবাড়ি, ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। মানুষের চলাচলসহ গবাদি পশুর তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। ভিটেবাড়িতে পানি ওঠায় ঐসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে সাপ ও ডাকাত আতঙ্ক প্রবল হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় কাজ হারিয়ে অনেকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

কুড়িগ্রামে ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ অন্যান্য নদীর পানি বেড়ে আবারও বন্যার অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে শতাধিক চরের নিচু এলাকা। পানিবন্দি ৩০ সহস্রাধিক মানুষ। কুষ্টিয়ায় শেখ রাসেল-হরিপুর সেতু রক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক। বালুর বস্তা ফেলেও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে বিপত্সীমার ওপরে বইছে যমুনার পানি। ফরিদপুরে পদ্মার পানি কমলেও জেলার বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে শত শত বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে বিপত্সীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনার পানি। জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে।

 

বাড়ি-ঘরে পানি উঠে পড়ায় মানুষ বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উঁচু স্থানে অস্থায়ী ঘর তুলে আশ্রয় নিচ্ছেন। বগুড়া অফিস জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাসনিয়া জানিয়েছেন, যমুনা নদীর পানি বিকাল থেকে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে উপজেলার কাজলা, কর্ণিবাড়ী, বোহাইল, চালুয়াবাড়ী, সারিয়াকান্দি সদর, হাটশেরপুর, চন্দনবাইশা এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। এতে জমির আমন, আউশ ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি পানিতে তলিয়ে গেছে। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, কয়েক দিন ধরেই নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এ ধারা আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে।

কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা ফজলে ইলাহী স্বপন জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপত্সীমার ২৪ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপত্সীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলায় পানি বেড়েছে ১৯ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রে বেড়েছে ১৫ সেন্টিমিটার। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চরাঞ্চলের স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ৭ হাজার হেক্টর আমনখেত পানিতে তলিয়ে গেছে। চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে চারটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় লোকজন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাউবো বাঁধসহ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে।

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি, ৮ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

রাজারহাট উপজেলার কিং ছিনাই গ্রামের ধরলার ভাঙনে গত এক সপ্তাহে ৩০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ধরলা অববাহিকার ৩০টি পয়েন্টে নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার সকালে পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপত্সীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পাংশার সেনগ্রাম পয়েন্টে পানি ১০ সেন্টিমিটার কমলেও এখনো বিপত্সীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চরের পানিবন্দিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবারের শিশু, বয়স্ক মানুষ আর গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। চুলা ভিজে যাওয়ায় ঠিকমতো রান্নাও করতে পারছেন না। চলাচলের একমাত্র ভরসা এখন নৌকা। বাজার বা অন্যান্য কাজের জন্য রাজবাড়ী শহরে যেতে হলে নৌকায় করে পাড়ি দিতে হয় উত্তাল পদ্মা। আর চরের বাসিন্দা হওয়ায় কেউ তাদের খোঁজখবরও খুব একটা নিতে পারেন না। তাই দুর্ভোগ তাদের আরও বেশি। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফুল হক জানান, প্রত্যেক উপজেলার যেসব এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে সেসব স্থানে এরই মধ্যে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেছে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ মজুত আছে। এখন পর্যন্ত জেলায় সাড়ে ৭ হাজার পানিবন্দি পরিবারের তালিকা পাওয়া গেছে।

 

লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধরলার পানি বিপত্সীমার ১৪ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামের ৪৫০টি চর, দ্বীপচর ও নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে এসব এলাকার ফসলের খেত ও রাস্তাঘাট। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চল থেকে পানিবন্দি লোকজন তাদের আসবাবপত্র ও গরু-ছাগল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসতে শুরু করেছেন। একই সঙ্গে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার ১০টি গ্রামের ২ হাজারের বেশি মানুষ। তাদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ও সরকারি রাস্তায়। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলে নদ-নদীর পানি ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে পড়ে। তাই ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপত্সীমার ওপরে থাকলে তার পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পায়। এতে অন্যান্য নদ-নদীর পানিও বেড়ে যায়।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আরও বাড়তে পারে। সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা মাহমুদুল কবির জানান, যমুনা ও অভ্যন্তরীণ চলনবিল, ইছামতি, করতোয়া, ফুলজোড় ও বড়াল নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার নিম্নাঞ্চল, চরাঞ্চলের নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হচ্ছে। চিলমারী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা নজরুল ইসলাম সাবু জানান, টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢলে বিপত্সীমা পেরিয়েছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এতে চিলমারী উপজেলায় নদীর তীরবর্তী কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ফসলি জমি। বাড়ছে জনদুর্ভোগ। উপজেলা নির্বাহী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর