তালেবানের আফগান দখল পাল্টে যাচ্ছে আঞ্চলিক রাজনীতির অঙ্ক!

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আবারও আফগানিস্তানের ক্ষমতার দখল নিয়েছে তালেবান। ২০ বছর পর হঠাৎ করে আফগানিস্তান কট্টর তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আসায় শুরু হয়েছে নতুন করে উত্তেজনা আর ভূ-রাজনীতির মেরুকরণ। কৌশলগত নিরাপত্তা আর অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে আঞ্চলিক ও বৃহৎ শক্তি ও রাষ্ট্রগুলো নতুন অঙ্ক মেলাতে শুরু করেছে।

ভারত, চীন, পাকিস্তান, ইরান ও রাশিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলো নতুন হিসাব-নিকাশ করছে। আর সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বেকায়দায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিমা মিত্ররা। বর্তমান আফগানিস্তানকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতি কোন্ দিকে মোড় নেবে তা হয়তো আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিষ্কার হবে।

তালেবান ক্ষমতা নেওয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছে আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ ভারত। গত এক সপ্তাহের বেশি সময়ে কোনো নীতি চূড়ান্ত করতে পারেনি দেশটি। ভারতের গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা বিভিন্নমুখী বক্তব্য দিচ্ছে। অবশেষে নরেন্দ্র মোদি সরকার আগামী বৃহস্পতিবার আফগান ইস্যুতে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছে। গত ১৭ আগস্ট ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির বৈঠকে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা হয়।

কিছু পর্যবেক্ষক সতর্ক করে বলছেন, তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর দেশটিতে ভারতের বিনিয়োগ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। গত দুই দশকে সেখানে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত।

কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত সরকারের জন্য তালেবান বড় মাথা ব্যথার কারণ। সেখানকার ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এর আগেও তালেবান ও আলকায়েদার সম্পর্ক ছিল। ক্ষমতায় এসে তালেবান তাদের সমর্থন দিক সেটি কখনো ভারত চাইবে না। সে জন্যই সবদিক বিবেচনায় রেখে নীতি সাজাতে চায় ভারত।

তালেবানের সঙ্গে চীনের সখ্যতা এখন দৃশ্যমান। উইঘুর ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না বলে বেইজিংকে আগেই আশ্বস্ত করেছে তালেবান। তারা আফগানিস্তান পুনর্গঠনে চীনের সহায়তা চায়। আপাতত তালেবানের ওপর আস্থাশীল চীন বলছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যে তালেবান শাসন আমরা দেখেছি, তার থেকে তারা এখন অনেক বেশি ‘স্পষ্ট এবং বাস্তবিক ভাবে’ ভাবছে। ইতিমধ্যে চীন আফগানিস্তানে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যার আকার হতে পারে ১০০ বিলিয়ন ডলার।

তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণে ইতিমধ্যে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছে পাকিস্তান। দেশটি সব সময় মনে করে, কাবুলে পাকিস্তানপন্থি একটি সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মাথায় ভারত সমীকরণ কাজ করছে। পাকিস্তান মনে করে, তালেবান সব সময় পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে এবং আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব তাতে খর্ব হবে।

পাকিস্তানের বিশ্বাস, অতীতে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়ে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী তত্পরতায়, বিশেষ করে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদে মদত দিয়েছে এবং কাবুলে আশরাফ ঘানি সরকার তাতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান আশা করে, আফগানিস্তান মাল্টিবিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে (সিপিইসি) যোগ দেবে। একই সঙ্গে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনশিয়েটিভেও কাবুলকে চায় ইসলামাবাদ।

যুক্তরাষ্ট্র সেনা সরিয়ে নেওয়াতে খুশি আফগানিস্তানের আরেক প্রতিবেশি দেশ ইরান। তবে তারা দেশটির স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। বর্তমানে সাড়ে সাত লাখ আফগান শরণার্থী ইরানে অবস্থান করছে। তালেবান ক্ষমতায় আসায় এই সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা করছে দেশটি। এছাড়া অতীতে ইরান-তালেবান সম্পর্ক কখনোই আন্তরিক ছিল না।

বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিধর দেশ রাশিয়া তালেবান শাসন নিয়ে এখনো নরম মনোভাব দেখিয়েছে। তালেবান নেতারা রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কয়েক দফা আলোচনা করেছে। পুতিন সরকার তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

অন্যদিকে সেনা সরানোর আগেই কাবুল দখল হবে সেটা ভাবতেই পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে বাইডেন প্রশাসন। তালেবানের বিরুদ্ধে পালটা ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তারা বিনা রক্তপাতে মার্কিন নাগরিক ও সেনাদের সরাতেই বেশি মনোযোগী। এই হিসাবও করছে যে ২০ বছরে সাড়ে ছয় লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকার পৌনে চার কোটি মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসেনি।

‘নস্ফিল’ আফগানযুদ্ধ আর চালিয়ে যেতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। তাই আফগানিস্তানের ভবিষ্যত্ দেশটির জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়াকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছে তারা। তবে বৃহত্ পরাশক্তি হিসেবে আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকবেই।

সেসঙ্গে আফগানিস্তানে তাদের নীতির ‘ইউটার্ন’ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। তালেবান কিংবা অন্যকোনো জঙ্গি সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত হানলে বাইডেন প্রশাসন চাপের মুখে হয়তো আবারও আফগানিস্তানে ফিরতে পারে মার্কিন সেনা।

ফিরে দেখা:

১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তালেবান। সে সময় তালেবান নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি গ্রুপ। যাদের অন্যতম ছিল আল কায়েদা। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর (৯/১১) যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহতম যে সন্ত্রাসী হামলা হয় তার জন্য আল কায়েদাকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর জঙ্গিবাদ নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে। সেই অভিযান শুরুর অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষমতা হারায় তালেবান।

 

এরপর টানা ২০ বছর মার্কিন ও পশ্চিমা যৌথ বাহিনীর সেনারা আফগানিস্তানে অবস্থান করেছে। যদিও এই সময়ে তালেবানকে পুরোপুরি পরাস্ত করতে পারেনি পশ্চিমারা।

এক হিসাবে দেখা যায়, এই সময়ে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন ও ১ হাজার ২০০ ন্যাটো সেনা প্রাণ হারিয়েছে। আরো প্রাণ গেছে এ লাখের বেশি আফগান, সেনা, পুলিশ, বেসামরিক মানুষের। আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই সময়ে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ কোটি ডলারের বেশি (২ ট্রিলিয়ন ডলার)।

এই যুদ্ধে আসলে কোনো পক্ষই জয়ী হবে না এমন ধারণা আগে থেকেই ছিল। সাবেক ট্রাম্প প্রশাসনের শেষদিকে আফগান যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা হয়। শেষ পর্যন্ত বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তালেবানের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা বেধে দেন। কিন্তু এর আগেই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলে অভিযান শুরু করে তালেবান। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হওয়ার আগেই তারা আফগানিস্তানের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর