তালেবানকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ কী হবে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর সারা বিশ্বের মিডিয়ায় সংবাদটি এমনভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে যেন এটিই এখন বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। কেউ মন্তব্য করছেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে উগ্রবাদী শক্তির প্রভাব বাড়তে পারে। আবার অনেকে মতামত দিয়েছেন, এ অঞ্চলে মার্কিনিদের পরাজয় হয়েছে-যেভাবে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর তারা ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম থেকে পালিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন অবশ্য তার বক্তৃতায় এ ঘটনাকে সায়গনের সঙ্গে তুলনা করেননি। তিনি স্বীকার করেছেন, ৯/১১ হামলার জন্যই আমরা আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। অর্থাৎ তারা নিশ্চিত ছিলেন, ৯/১১ হামলার জন্য আফগানিস্তান এবং এর সমর্থনপুষ্টরা দায়ী ছিল। প্রমাণ অবশ্যই তাদের হাতে ছিল, নতুবা একটা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায় না। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনো নিশ্চিত গ্রহণযোগ্য প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্র হাজির করতে পারেনি-প্রকৃত অর্থে কে বা কারা ৯/১১ হামলা করেছিল।

তালেবান সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে জানতে হবে এরা কারা এবং কে তাদের তৈরি করেছিল। ফিরে যেতে হবে প্রায় চার দশক আগের স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে। ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে দেশটিতে সোভিয়েতপন্থি কমিউনিস্ট সরকারের ক্ষমতা পোক্ত হয়, যা যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারেনি। কমিউনিস্ট ব্লকের আফগানিস্তান দখলে উড়সরহড় ঞযবড়ৎু-এর ভীতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পুঁজিবাদী ব্লক এতটাই ভীত ছিল যে তারা দ্রুত আফগানদের ভেতর জিহাদি চেতনা জাগাতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। মার্কিনিদের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই-আফগানদের যে কোনো মূল্যে বোঝানো যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিদেশি শক্তি; তারা জোরপূর্বক তোমাদের দেশ দখল করে আছে; কাজেই তাদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। পর্যাপ্ত অর্থ, সামরিক সহায়তা, এমনকি আফগানদের মগজধোলাই করে জিহাদি চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য লাখ লাখ জিহাদি বই আফগান বিদ্যালয়গুলোতে সরবরাহ করা হতো। এ বইগুলোতে কাঁধে অস্ত্র নিয়ে যুবকের ছবি থাকত। ক্রিস ব্রাউন, যিনি এ প্রজেক্টের মধ্য এশিয়া টাস্কফোর্সের প্রধান ছিলেন, তিনি বলেছেন, ‘I think we were perfectly happy to see these books trashing the Soviet Union,’ (The Washington Post, 23 March 2002). অর্থাৎ আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী আফগান মুজাহিদিনদের তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটা একটা প্রতিষ্ঠিত মত, যা লুকানোর কিছু নেই। এক দশক পর সোভিয়েত বাহিনীর আফগানিস্তান ত্যাগ করাকে মার্কিনিদের ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসাবে স্বীকার করা হয়। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী চলে যাওয়ার পর শুরু হয় ক্ষমতা দখল নিয়ে গৃহযুদ্ধ। মুজাহিদিনদের দল কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন দল ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা দখল করে নেয়। মোল্লা ওমর একজন মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। তিনি মার্কিন সমর্থনপুষ্ট একজন প্রশিক্ষিত মুজাহিদ, যিনি সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তার সংগঠন মুজাহিদিনদের একটা বড় অংশ মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। পশতু শব্দ তালেবান অর্থ ছাত্র। সেখান থেকেই নামকরণ হয়েছে তালেবান। আফগানিস্তানে পশতু হলো সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী। মোল্লা ওমর পশতু গোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করেছেন।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানরা ক্ষমতায় ছিল। বলা হয়, তালেবানরা ক্ষমতায়ও এসেছিল মার্কিনিদের সহায়তায়। ২০০১ সালে ৯/১১-এর হামলার পর বিশ্ব রাজনীতির কাঠামো পরিবর্তন হয়ে যায়। রাজনীতির মঞ্চে চলে আসে সন্ত্রাসবাদ। পশ্চিমারা অত্যন্ত সফলভাবে গোটা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, যে কোনো হামলার পেছনে সন্ত্রাসবাদ লুকিয়ে আছে। ৯/১১ হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা করেছিলেন, যারা আমাদের সঙ্গে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ নেই, তারা সন্ত্রাসীদের পক্ষে। এখানে প্রশ্ন আসে- ৯/১১-এর হামলা কারা চালিয়েছিল? সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা কি যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ঠিক করবে. আর তার পক্ষ নিয়ে অন্যদের যুদ্ধ করতে হবে? মার্কিনিদের তৈরি সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা যে ভুল ছিল, তা সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। ইরাক যুদ্ধের পর টনি ব্লেয়ার ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরাক অভিযানে যোগদানের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তিনি বলেছেন, ‘For all of this, I express more sorrow, regret and apology than you can ever know or believe.’ (The Guardian , 6 July 2016).

৯/১১ হামলার জন্য আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয়, যিনি আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং মোল্লা ওমরের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানে বিমান হামলা শুরু করে। কয়েক মাসের মধ্যে তালেবানদের পতন হলেও মার্কিন-তালেবান যুদ্ধ চলেছে প্রায় দুই দশক।

আফগানিস্তানের এখন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলছে। তালেবানের ক্ষমতায় আসাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের বৃহৎ শক্তিগুলো নানা হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে। গড়ে উঠেছে মার্কিনবিরোধী এক শক্তিশালী ব্লক। চীন-রাশিয়া ব্লকের সমর্থনপুষ্ট আঞ্চলিক শক্তিগুলো এ অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য দেখতে চায় না। কূটনীতির ভাষ্যে বোঝা যাচ্ছে, তালেবান সরকার গঠন করার পর চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে বেশি দেরি করবে না।

তালেবানের বিজয় অবশ্যই মার্কিন শক্তির পরাজয়। আর এ প্রশিক্ষণ তারা পেয়েছে মার্কিনিদের কাছ থেকেই, যার মাধ্যমে তারা সোভিয়েত বাহিনীকে বিতাড়িত করেছিল। ১৯৭৫ সালে সায়গন থেকে মার্কিন বাহিনী যখন পালিয়েছিল, এটি অনেকটা সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। ভিয়েতনামে মার্কিনিদের পরাজয়ে মার্কিন নাগরিক ও মার্কিনপন্থিদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করে ওঠা হেলিকপ্টারের সেই ছবি মিলে যায়, যখন কাবুল থেকে ইউএস এয়ারফোর্সের বিশাল বিমানটি চলে যাচ্ছিল। বাইডেন প্রশাসন স্পষ্ট করে বলেছে, আলোচনা ছাড়া এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কিন্তু গত প্রায় দুই দশকের যুদ্ধে আফগানিস্তানে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর দায় কে নেবে সেই প্রশ্ন আজ সামনে আসছে না, বরং দুনিয়াব্যাপী আলোচিত হচ্ছে আফগানিস্তানে আবার জঙ্গিবাদের সম্ভাব্য উত্থান নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেয়ে গেছে পশ্চিমাদের শেখানো বুলি-নারী অধিকার, মানবাধিকার, মানবতাবাদ ইত্যাদি। ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাঠামো দ্বারা আবৃত জ্ঞানের এটি একটা বড় সমস্যা। তারা পশ্চিমাদের তৈরি করা চিন্তাকাঠামোর বাইরে চিন্তা করতে পারে না। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে জঙ্গিবাদের। এ অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি চীন-রাশিয়া আফগানিস্তানে তালেবানের সরকার গঠনের ওপর দৃঢ় নজর রাখছে। তবে সরকার গঠনের পর চীন-রাশিয়ার তালেবান শাসনাধীন আফগান নীতি কী হবে তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ান স্টাডিজ বিশেষজ্ঞ ডেভিড জি লিউইস মনে করেন, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল থেকে মার্কিনিদের বের করে দেওয়াই রাশিয়ার মূল লক্ষ্য। এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সুসম্পর্ক ছিল। রাশিয়া এ অঞ্চলে মার্কিনবিরোধী জোট গড়তে চায় এটা স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে আফগানিস্তান রাশিয়ার জটিল ভূ-রাজনীতির নতুন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে। ইগর সাবোতিন রাশিয়ার আফগান নীতিকে মূল্যায়ন করেছেন ‘Seizing the initiative from the west’ হিসাবে (https://www.marshallcenter.org)।

অর্থাৎ এ অঞ্চলগুলোতে আধিপত্য বিস্তারে রাজনৈতিকভাবে আমেরিকাকে পরাজিত করা মস্কোর মূলনীতি। মস্কো সফলভাবেই সে কাজটি করার চেষ্টা করছে। রাজনীতির মাঠে গোল দেওয়া মস্কোর অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। পাশাপাশি রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে নিজ দেশে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এজন্য কখনোই চাইবে না আফগানিস্তানে এমন কোনো শক্তির উত্থান হোক, যার জন্য মস্কো হুমকির মুখে পড়বে।

চীনের আফগান নীতি অনেকটাই ভিন্ন। ধারণা করা হচ্ছে, আঞ্চলিক শক্তি পাকিস্তান ও ইরানের মেগা প্রকল্পের আর্থিক জোগানদাতা হিসাবে চীন যেভাবে হাজির হয়েছে, একইভাবে আফগানিস্তানে চীনের উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। রাশিয়ার মতো চীনও আফগানিস্তানের প্রতি বিশেষ নজর রাখবে, যাতে নিজ দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা না করতে হয়।

আঞ্চলিক শক্তি পাকিস্তানের আমেরিকার সংজ্ঞায়িত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ১৪ বছরে এ যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১১৮.২০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পাকিস্তানও এরকম নতুন কোনো লড়াইয়ে আর যোগদান করতে চাইবে না। আফগানিস্তানে পাক-চীন জোটের মোকাবিলায় ভারত যে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারবে না তা মোটামুটি স্পষ্ট। পূর্ববর্তী মার্কিন মদদপুষ্ট আফগান সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক ছিল এবং এ অঞ্চলে ভারত বিপুল অঙ্কের যে বিনিয়োগ করেছে, তা এখন হুমকির মুখে পড়তে পারে।

মোদ্দাকথা, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে তালেবানদের সরকার গঠন পর্যন্ত। সরকার গঠনের পর তাদের রাষ্ট্রনীতি স্পষ্ট হলে বোঝা যাবে আফগানিস্তানে কী হতে চলছে। মনে রাখতে হবে, দুই দশক আগের দুনিয়া আর এখনকার দুনিয়া এক নয়। পরিবর্তন এসেছে বিশ্ব রাজনৈতিক কাঠামোতে। পশ্চিমাদের শেখানো বুলি শুধু নারী অধিকার আর মানবাধিকার নয়; বরং আফগানিস্তানের প্রত্যেক নাগরিক যেন একটি স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার জন্য সব অধিকার ভোগ করতে পারে, সেটাই প্রত্যাশা হওয়া উচিত।

মো. শফিকুর রহমান : সহকারী অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর