লকডাউন শিথিলের এপিঠ-ওপিঠ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আকবর মিয়া গার্মেন্টে চাকরি করেন। কঠোর লকডাউনেও গার্মেন্ট চালু রেখেছে মালিক সমিতি। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো রিকশায় করে যাচ্ছেন তিনি। বেতনের টাকা পথেই চলে যাচ্ছে। রিকশায় ত্রিশ টাকার ভাড়া দেড়শ টাকা। এরপর খাওয়া-দাওয়া আছে, ঘরভাড়া আছে। ভোগান্তির যেন শেষ নেই।

এসব মেনে নিলেও ঈদের সময় বাড়ি না যাওয়াটা আকবর মিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। পরিবার থাকে গ্রামে। ছেলেমেয়ে আছে। আছে বুড়ো বাবা-মা আর বউ। তাদের মুখের হাসি আকবর মিয়ার কাছে শত মাসের বেতনের চেয়ে দামি। পথের ঝক্কি-ঝামেলা উপেক্ষা করে যেভাবেই হোক বাড়ি তাকে যেতেই হবে।

এমন অনেক আকবর মিয়া, কুলসুম, রাহেলা, কমলা আর মিরাজের মতো মানুষ কাজ করছেন আমাদের শহরগুলোতে। তারা পরিবারের টানে ঈদে গ্রামে ফিরবেন, পরিবারের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করবেন, এটাই স্বাভাবিক।

গত ঈদে দেশে লকডাউন ছিল। এরপরও হাজার হাজার মানুষের বাড়ি যাওয়া আটকাতে পারেনি সরকার। পথের শত কষ্ট উপেক্ষা করে প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে গেছে তারা। তাই এবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে লকডাউন শিথিলের। তবে সেটা ১৫ তারিখ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত। ২৩ তারিখ থেকে আবার কঠোর লকডাউনে যাবে সরকার।

সরকারকে ধনী-গরিব সবার কথা চিন্তা করতে হয়। বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। যে পরিবারটা সারা বছর পাঁচ-ছয়টা গরু পালন করে বড় করেছে কুরবানিতে বিক্রি করবে বলে, লকডাউন থাকলে তাদের কী উপায় হবে? দোকানিদের কী হবে?

দোকানিরা বছরে ঈদ, পূজা, নববর্ষসহ কিছু উৎসবে বেচাকেনা বেশি করেন। এই দেড় বছর তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। মূলধনে টান পড়েছে। কোনো কোনো দোকানি মূলধন খেয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অনেকে বেকার হয়ে পথে বসেছেন। ফুটপাতে যারা ব্যবসা করতেন, তাদের অনেকে কোনো কাজ না পেয়ে চুরি করছেন। শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন অনেকে।

গরিব মানুষের কাছে লকডাউন বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো। আমাদের দেশে এখনো দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। গত বছর সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে অসহায় মানুষ সহায়তা পেয়েছিল।

এবারের লকডাউনে তেমন কোনো মানবিক সহায়তায় সাড়া মিলছে না। গরিব মানুষ যে কতটা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে তা সহজেই অনুমেয়। করোনায় মৃত্যু বাড়ছে। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। কোনো পরিবার তার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারাচ্ছে। আবার কোনো সন্তান হারাচ্ছে তার বাবা-মা-আপনজনকে।

ঈদ উপলক্ষ্যে করোনা পরিস্থিতিতে সরকার লকডাউন শিথিল করেছে যেমন ইচ্ছা তেমন চলার জন্য নয়। লকডাউন শিথিল হওয়ায় বাইরে চলাফেরার সময় নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় ঘরে বসেই ঈদ কাটালে। মানুষকে বুঝতে হবে তার ভালো-মন্দের দিকটা। লঞ্চ, বাস, স্টিমারসহ যানবাহনে চলাচলের সময় করোনার কথা ভুলে গেলে চলবে না। মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে।

সামাজিক দূরত্ব অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আবার যারা যে এলাকায় যাচ্ছেন, সে এলাকাগুলোতেও এখন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গিয়ে যেন আমরা মৃত্যুকে ভাগাভাগি না করি। অনেক পরিবারেই বয়স্ক মানুষ আছেন, যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। একবার তারা করোনায় আক্রান্ত হলে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে। তাই সময় থাকতে সাবধান হতে হবে।

লকডাউন শিথিল হওয়া মানে আপনার নিরাপত্তা শিথিল হওয়া নয়। আপনার পরিবারের নিরাপত্তা আপনার কাছে। আপনার জীবন-মৃত্যু আপনার হাতে। উৎসব পালনের সুযোগে আমরা যেন নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা না ডেকে আনি, সেদিকে প্রত্যেকের খেয়াল রাখতে হবে।

তুষার কান্তি সরকার : সম্পাদক, প্রকৃতিবার্তা

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর