থামানো যাচ্ছে না গাড়ি ও মানুষ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  করোনায় কঠোর বিধিনিষেধের ১০ দিনে গতকাল অনেকটাই শিথিল পুলিশের চেকপোস্ট। সে কারণে গত কয়েক দিনের তুলনায় রাজধানীতে আবার মানুষ ও যানচলাচল বেড়েছে। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্থাপিত চেকপোস্টগুলো শিথিল হওয়ায় মহাসড়কে দেদারছে চলছে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। শুধু তাই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, গত শুক্রবারের তুলনায় মানুষ ও যানচলাচল বেড়েছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট থাকলেও বেশিরভাগই ছিল নিষ্ক্রিয়। এ কারণে কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই মানুষ ও যানবাহন চলাচল করে।

তবে গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭৯১ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২১২ জনকে ১৬ লাখ ৬ হাজার ৪৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ ৩৬১টি গাড়িকে ৯ লাখ ৪ হাজার ৫শ’ টাকা জরিমানা করে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শনিরআখড়া ওভারব্রিজের নিচে ঢাকা থেকে বের হওয়ার মূল চেকপোস্টে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো চেক হচ্ছে না। চেকপোস্টে তিনজন কনস্টেবল সার্জেন্টদের মোটরসাইকেলের ওপর বসে আছেন। খানিক দূরে তিনজন সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলেন। চেকপোস্টের পরিস্থিতি জানতে চাইলে তারা বলেন, সকালের নাশতার বিরতি যাচ্ছে। এখন আবার কার্যক্রম শুরু হবে। কিছু সময় পরই গড়ি চেক করা শুরু করেন।

দায়িত্ব পালনকারী যাত্রাবাড়ী ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট মাসুদ রানা বলেন, শনিবার হওয়ায় গাড়ি একটু কম। তবে রিকশা-ভ্যান প্রচুর দেখা যাচ্ছে। চেক করার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা যাচ্ছে কি নাÑ জানতে চাইলে বলেন, দেখেন আপনি, চলতে পারবে না এমন কোনো গাড়ি চলছে কি না দেখেন। সিএনজি অটোরিকশায় হয় রোগী, না হয় বিদেশযাত্রী। প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসে করে শিল্পকারখানার কর্মকর্তা, শ্রমিকরা যাতায়াত করছেন। চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী একজন সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করে বলেন, একটা সিএনজি অটোরিকশা ধরছিলাম, যেটা ২০০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী নিয়েছে। ধরার পর চালক পায়ে ধরে কেঁদে দিয়েছেন। সংসার চলে না, বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে বের হয়েছেন। এসব কেস কী করব বলেন, আমরাও তো মানুষ। বাস্তবতা বুঝি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এই চেকপোস্টগুলো এখন মূলত তাদের বড় কোনো কর্মকর্তা কিংবা গণমাধ্যমের কর্মীরা এলে সক্রিয় হয়। এ ছাড়া বেশির ভাগ সময় দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনেকটা রিল্যাক্সে থাকেন। শনিরআখড়ার চেকপোস্টের পর রায়েরবাগেও মহাসড়কের দুই পাশে দু’টি চেকপোস্ট রয়েছে। সেগুলো গত কয়েক দিন ধরেই অনেকটা নিষ্ক্রিয়।

চেকপোস্টগুলোর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করছে হরদম। মহাসড়কে এসব অটোরিকশা আগে থেকেই নিষিদ্ধ। গতকাল দেখা গেছে, শনিরআখড়ায় মূল চেকপোস্ট থেকে খানিকটা পশ্চিম দিকে মহাসড়কে আন্ডারপাসের ওপর এসব ইজিবাইকগুলো স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে। সেখান থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় সাইনবোর্ড যাওয়ার যাত্রী তোলা হচ্ছে। এই মহাসড়ক ধরে অনেক ভ্যানগাড়িকেও যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে।

বালিয়াকান্দি (রাজবাড়ী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গতকাল শনিবার সকালে উপজেলার বহরপুরসহ বিভিন্ন হাট-বাজারে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ৯ জনের ৯শ’ টাকা ও শুক্রবার সকালে নারুয়া বাজারসহ বিভিন্ন হাট-বাজারে অভিযান পরিচালনা করে ৮ জনের ২৪শ’ টাকা মোবাইল কোর্টে জরিমানা করা হয়। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা। তিনি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে সরকার ঘোষিত আদেশ কোনো ব্যক্তি অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রাজবাড়ী জেলা সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে বসন্তপুরস্থ মজলিশপুর সাইনবোর্ড এলাকায় শনিবার সকাল থেকেই লকডাউন আরো কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়েছে। রাজবাড়ী সদর উপজেলার মজলিশপুর সাইনবোর্ড এলাকায় কর্তব্যরত ফরিদপুর হাইওয়ের (মাদারীপুর রিজিয়ন) সহকারী পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কঠোর লকডাউন পালিত হচ্ছে।

সহকারী পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম সিদ্দিকী জানান, দিন-রাতে এখানে হাইওয়ে পুলিশ ডিউটি করবে। করোনাকালীন বাস্তবতায় জনসাধারণকে গণপরিবহনযোগে চলাচলে অনুৎসাহিত করা এবং জীবন রক্ষার্থে সরকারি নির্দেশনা প্রতিপালনের জন্য জনগণকে ঘরমুখী রাখার জন্য সব পদক্ষেপ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হাইওয়ে পুলিশ দিন-রাত তৎপর রয়েছে।

ফরিদপুর জেলা সংবাদাতা জানান, ফরিদপুর জেলা পুলিশের উদ্যেগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রেখে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানকল্পে বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধ পালনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ফরিদপুর জেলা সদরে কোতোয়ালি থানা ও অন্যান্য ৮টি থানা এলাকায় মোট ১২টি চেকপোস্ট ও ২৯টি মোবাইল টিম গঠনের মাধ্যমে নিরলসভাবে ফরিদপুর জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। ফরিদপুর জেলা পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং বাংলাদেশ আনসারের সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

এ এম মিজানুর রহমান বুলেট, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, কলাপাড়ায় দশম দিনে লকডাউন না মানায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১৩ জনকে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কলাপাড়া পৌর শহরের সদর রোড, চৌরাস্তা, পাখিমাড়া বাজার এবং মহিপুর বাজারে এ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এ সময় ১৩ জনকে ৯ হাজার ৩শ’ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়।

কাপ্তাই (রাঙ্গামাটি) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, রাঙ্গামাটি কাপ্তাইয়ের চিৎমরম বাজারে শনিবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুনতাসির জাহান। এ সময় তিনি করোনা প্রতিরোধে বিনা প্রয়োজনে মানুষকে ঘরের বাইরে অহেতুক ঘোরাফেরা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ২টি মামলায় ৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায়সহ মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। এ সময় উপজেলা নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক ইলিয়াস, নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস সুপার সিরাজুল ইসলাম, ৪১ বিজিবি ও চন্দ্রঘোনা থানার পুলিশ সদস্যরা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সহায়তা করেন।

স্টাফ রিপোর্টার মাগুরা থেকে জানান, মাগুরা জেলা শহর এবং উপজেলা হেডকোয়ার্টারে প্রশাসনের ব্যাপক জিঙ্গাসাবাদের সম্মুখীন হতে হলে ও শহরের অলিগলি এবং গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাট জমজমাট আড্ডার স্থলে পরিণত হয়েছে। সরকারের দেয়া কঠোর লকডাউনের ১০ দিন চলছে মাগুরা জেলায় এভাবেই। শহরে লোক সমাগম কম হলেও দোকানগুলো সাটার বন্ধ করে সামনেই দোকানি বসে বিক্রেতাকে তার চাহিদার পণ্য দিচ্ছে। মোবাইল কোর্ট এলেই সাটার বন্ধ, চলে গেলেই আবার স্বাভাবিক। এ পর্যন্ত ১৪টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৩৯১ মামলায় এক লাখ ৪২ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বড়দের পাশাপাশি কোমলমতি শিশুরা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে বিচরণ করছে অলিগলিতে।

নোয়াখালী ব্যুরো জানায়, লকডাউনে চলমান বিধিনিষেধ অমান্য করায় ১০৬ জনকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সুবর্ণচর, চাটখিল ও কবিরহাটসহ কয়েকটি স্থানে গরুর হাট বন্ধ করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নোয়াখালীর ৩টি উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত ১০৬ জনকে জরিমানা করে। জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. খোরশেদ আলম খান জানান, লকডাউন কার্যকর করতে ও জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করতে জেলার বিভিন্ন বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১০৬টি মামলায় জরিমানা করা হয়েছে।

সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে কঠোর বিধিনিষেধ। লোকজনের চলাচল বেড়েছে রস্তাঘাটে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে সিলেটে বেড়ে চলছে মৃতের সংখ্যা। পরিস্থিতি দিন দিন ভয়ঙ্কর হচ্ছে। এ বিভাগে করোনাভাইরাস শনাক্তের হার আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষাকৃত নমুনার মধ্যে ৫৫ দশমিক ৪১ শতাংশের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তবে জেলাভিত্তিক সিলেটে শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি।

শনিবার সকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সুলতানা রাজিয়া স্বাক্ষরিত কোভিড-১৯ কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের দৈনিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিভাগের ৭১১টি নমুনা পরীক্ষা করে রেকর্ড শনাক্তের হারে ৩৯৪ জন মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। হার বিবেচনায় বিভাগে সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে সিলেট জেলায়। সিলেট জেলায় ৪৮৪টি নমুনা পরীক্ষায় ২৯২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৬০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এছাড়া, সুনামগঞ্জে ৩৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১৩ জনের, হবিগঞ্জে ৭৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৩৫ জনের এবং মৌলভীবাজারে ১১৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫৪ জনের। শনাক্তের হার যথাক্রমে ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, ৪৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ৪৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এদিকে, সিলেটে কঠোর লকডাউনের তেমন প্রভাব চোখে পড়েনি সড়ক ও অলিগলিতে। শুধু অফিস-আদালত আর গণপরিবহন বন্ধ ছাড়া বাকি সব কিছু অন্য দিনের তুলনায় স্বাভাবিক। মার্কেট-শপিংমল বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে বাইরে অবস্থান করে মালামাল বিক্রি করতে দেখা যায়। সেই সাথে সিলেটের মাছ ও কাঁচাবাজারে ছিল মানুষের ভিড়। গতকাল সড়কের চেকপোস্টগুলোতে পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও চলাচল নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা ছিল কম। মাঝে-মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়ে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে দেখা গেছে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের।

মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষ যদি নিজে থেকে সচেতন না হন তাহলে পুলিশের পক্ষে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ও সচেতন করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবুও পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর