পিংক সিটিতে এক নারী আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন : শাবানা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বসে আছি শাবানার বসার ঘরে। বর্ণিল আলোয় উজ্জ্বল বসার ঘর। একদিকে স্বামী ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে প্রথম জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তের ছবি। খুবই হাস্যোজ্জ্বল বাংলা চলচ্চিত্রের এই অভিনেত্রী স্বামীকে কানে কানে কি যেন বলছেন- বাঁধাই করে সে ছবি টানিয়ে রাখা হয়েছে দেয়ালে। পাশে আলমিরায় থরে থরে সাজানো পুরস্কার। সেসবের দিকে গভীর মনোযোগ দিতেই ঘরে হাসিমুখে ঢুকলেন শাবানা। কুশল জানিয়ে বসলেন বিপরীত দিকের সোফায়। বসেই আমাদের কাছেই জানতে চাইলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। জানতে চাইলেন এখন কারা কারা অভিনয় করছেন। শাকিব খান, শাবনূর, মৌসুমী, পপি, রিয়াজ ফেরদৌস ছাড়া তেমন কাউকে চেনেন না। অপু বিশ্বাস কিংবা বুবলীর নাম মনে করতে পারলেন না শাবানা।

মিশার প্রসঙ্গে আসতেই ও য়াহিদ সাদিক বললেন, ‘মিশাকে তো আমি প্রথম ছবিতে নিয়েছিলাম পাঁচ হাজার টাকায়। ও ভালো করল। ওকে পরের ছবিতে আমি তিন লাখ টাকা দিয়েছিলাম। ছেলেটা খুবই ভালো।’

সিনেমা হলের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে শুনে শাবানার চোখেমুখে নেমে এলো কিছুটা অন্ধকার। হয়তো স্মৃতির গভীরে চলে গিয়েছিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে বললেন, ‘আমাদের সময় সিনেমা হল ছিল ১২ শ। এখন এত কমে যাচ্ছে। এখন কি ভালো সিনেমা হচ্ছে না?’ প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে বললেন, ‘আসলে এখনও শুনেছি কিছু ভালো সিনেমা হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো সংস্কৃতিমনা। তাহলে এই হাল কেন? এফডিসি শুনেছি অনেকটাই ফাঁকা থাকে এখন। এসব শুনলে খারাপ লাগে।’

নিজের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন। বললেন, ‘আমরা যখন শুটিং করতাম তখন এফডিসিতে ফ্লোর পাওয়া যেত না। সবখানেই শুটিং হচ্ছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে ফ্লোরের বাইরে সেট বানিয়ে শুটিং করত। সেই সব দিনের কথা ভাবলেই কতকিছু মনে পড়ে যায়। এখন চলচ্চিত্রের এমন দুর্দিন শুনলে খারাপ লাগে।’

ওয়াহিদ সাদিক প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে বললেন, ‘আমি এখনও সিনেমায় প্রযোজনা করতে রাজি আছি। কিন্তু এখন কি লগ্নি ফিরে আসবে? ধরেন আমি দেড় কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করে ৫-৭টা সিনেমা বানালাম কিন্তু লাভ না হোক মূলধন যদি ফিরে না আসে তাহলে সিনেমা বানাব কীভাবে? এখন সিনেপ্লেক্স মানুষ পছন্দ করছে। দেশে ১৭ কোটি মানুষ, যেখানে ১৭ শ সিনেমা হল দরকার সেখানে সিনেমা হল নেই। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সিনেপ্লেক্স বানানো দরকার। আমি সিনেমা বানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি, এজন্য সিনেমা হল দরকার। আর এটা করতে হলে চলচ্চিত্রের একজন নেতৃত্ব দরকার। যিনি সরকারের সঙ্গে বসে পুরো ধারণা নিয়ে আলাপ করতে পারবেন। পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।’

মাঘের শেষে সন্ধ্যার পরে, রাতগুলো বেশ শীতার্ত হয়। অথচ শাবানার ড্রয়িং রুমে শীত নেই। আমরা মানে কজন গণমাধ্যমকর্মী সোফার একদিকে। অন্যদিকে ওয়াহিদ সাদিক ও শাবানা। চলচ্চিত্রের আলাপ বেশ জমে উঠেছে। আমরা মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনছি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সময়ের কথা। শুরুর গল্পটা কেমন ছিল? শাবানা বললেন, ‘আমি তখন ছোট, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমার বাবার কাজিন ছিলেন এহতেশাম সাহেব। তিনি এক ঈদে বাসায় এসে বললেন, তোর মেয়েটাকে দে, আমার সিনেমায় অভিনয় করাব। বাবা বললেন, ও তো লাজুক ও পারবে না। এহতেশাম সাহেব বললেন, পারবে, তুই দে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। আমার রোলটা হলো ছোট বোনের। দৌঁড়ে এসে বলতে হবে ভাইয়া ভাইয়া আপুর বিয়ে। ভাইয়া বলবে তাই নাকি। শট দিলাম। এক টেকেই শট নেওয়া হলো। এহতেশাম সাহেব বাবাকে বললেন, দেখলি আমি বললাম না পারবে। এরপর তো বড় হয়ে চকোরী করলাম, আমার প্রথম চলচ্চিত্র। সেই ছবিতে আমার পারিশ্রমিক ছিল ৫ হাজার টাকা।’

শাবানা একটু থামলেন। বললেন, ‘চলচ্চিত্রে আসার পেছনে বাবা ছিলেন আমার বড় অনুপ্রেরণা। বাবার জন্যই হয়তো আমি এতদূর আসতে পেরেছি।’ তার মানে পরিচালকেরা চাইলে ভালো অভিনয় সম্ভব- প্রশ্নটা করেছিলাম শাবানাকে। বললেন, ‘আমাদের সময় পরিচালকরা ভালো ছিলেন। শিল্পীরা বিষয় না, শিল্পীরা কাদামাটির মতো। তাঁদের যেভাবে গড়ে নেওয়া হতো তারা সেভাবেই তৈরি হবেন। শুধু শিল্পী নির্ভর হলেই হবে না ভালো গল্প ও ভালো পরিচালক দরকার। চাল ডাল সব এনে দিলেন কিন্তু রাঁধুনী যদি ভালো না হয় তাহলে ভালো রান্না হবে কীভাবে?’

ববিতা-কবরীর সঙ্গেও অভিনয় করেছেন শাবানা। তাঁদের সঙ্গে কখনও প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে শাবানা বললেন, ‘আসলে আমি তো কখনো প্রতিযোগিতা করিনি, কাউকে পেছনে ফেলতে হবে এটা ভাবিনি। চিন্তা করতাম আমার চরিত্রটা সবচেয়ে ভালো কীভাবে করব। আমাকে একজন গ্রামের মেয়ের চরিত্র করতে হবে কিংবা বড়লোকের মেয়ের চরিত্র করতে হবে- তখন আমি খেয়াল করতাম সে কীভাবে হাঁটে, কীভাবে চলে, কীভাবে বসে। সবচেয়ে বড় কথা আমি ভাবতাম আমার চরিত্রটাই সবচেয়ে ভালো হতে হবে। আমার বিপরীতে বা পাশে কে আছে সেটা আমার মাথায় থাকত না। তবে পোশাকের বিষয়ে খুবই সচেতন ছিলাম।’ কথা বলতে গিয়ে বধূ বিদায় নামের একটি ছবির শুটিং অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল শাবানার। বললেন, ‘ওখানে আমাকে একটা গ্রামের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। পরিচালক কাজী জহির বললেন দেখ শাবানা এটা খুবই চমৎকার একটি চরিত্র। তুমি করতে পারলে খুবই সুন্দর হবে। আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কারণ শুধু শাড়ি গায়ে জড়িয়ে অভিনয় করতে হবে। আমি বললাম কাজী ভাই এটা আমি পারব না। তখন সেটা কবরী করল, আমি করলাম কবরীর চরিত্রটি। যতই হোক সবার একটা নিজস্বতা থাকে। আমি সেটা মেনে চলতাম।’

ঘড়ির কাঁটা যেন দ্রুত ঘুরছে। রাত বাড়ছে। অথচ মনে হলো এই একটু আগেই আমরা গল্প শুরু করেছি। কথা বলতে বলতে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত শাবানা যেন ঘুরে ফিরে পেছনে চলে যাচ্ছেন। বললেন, ‘নিউ ইয়র্কে বসে যখন কোনো নিজের অভিনয় করা সিনেমার ছবি বা ভিডিও দেখি মুহূর্তেই সেই সময়টায় চলে যাই। সে সময়ের প্রত্যেকটি মুহূর্ত যেন জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসে। সত্যি কথা বলতে কি যখন অভিনয় করেছি তখন ঘর-সংসার করা হয়নি। এখন পুরো সময়টাই সংসার করছি। নাতি-নাতনি হয়েছে তাদের সাথে সময় ব্যয় করি। এরপর বাকি সময়টা নামাজ-কালামের মধ্য দিয়েই কেটে যায়। এখন অবশ্য সিনেমা দেখা হয় না সেভাবে। এসবের মাঝেও অতীত তো চলে আসেই।’

নাতি-নাতনিরা আপনার অভিনয় সম্পর্কে জানতে চায় না? প্রশ্ন শুনে বেশ আনন্দ পেলেন মনে হয় বাংলা চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী। কিছুক্ষণ হাসলেন তারপর বললেন, ‘মাঝে মধ্যে আমাদের পুরনো ছবি কিংবা ইউটিউবে যখন আমার সিনেমার ক্লিপস ওরা খুঁজে পায় তখন জিজ্ঞেস করে ওরা- নানু তুমি অ্যাকট্রেস ছিলে? নানু তুমি অভিনয় করেছ কত সুন্দর। আচ্ছা আমরা কি তোমার মতো হতে পারব না? আমি ওদের প্রশ্ন শুনে হাসি, উত্তর দিতে পারি না।’

আমরা ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সর্বশেষ একটি প্রশ্ন- বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কাছে শেষ চাওয়া কী? শাবানা বললেন, ‘গতবার যখন দেশে আসি সেবার গুলশানের পিঙ্ক সিটিতে গিয়েছিলাম কি যেন একটা কিনতে। মাথার কাপড় ঠিক করতে গিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য মুখের একদিকে খুলে গিয়েছিল। পাশে একজন মহিলা আমার দিকে তাকালেন। তার মুখ হাঁ হয়ে গেল। শুধু একবার বলল- আপা আপনি শাবানা না? বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা করে বলল- আপা এই জীবনে আপনার সাথে দেখা হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। গল্পটা বললাম এই কারণে যে আমাকে এদেশের চলচ্চিত্রই সব দিয়েছে। আমাকে যদি কিছু চাইতে বলা হয় তবে আমি চাইব বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেন অনেক ওপরে যায়। ভালো ভালো সিনেমা হয়। এটা আমার ভালোবাসার জায়গা। আমি যদি নাও থাকি তবুও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেন ভালোভাবে বেঁচে থাকে।’

গত বছর শাবানার ঢাকার বাসা থেকে ফিরে  কিংবদন্তির সঙ্গে এক সন্ধ্যা শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ হয়েছিল কালের কণ্ঠের রঙের মেলায়। সেটার আরো বিস্তারিত উঠে এসেছে এই লেখায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর