চা দোকানির গল্পে জট খুললো পাঁচ বছর পুরনো ক্লু-লেস নাটকীয় খুনের রহস্য

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অজানা এক খুনের তদন্তের কাজে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো দায়িত্বরত এক কর্মকর্তাকে। কোনো উপায়েই খুনের রহস্য উদঘাটন করতে পারছিলেন না ওই কর্মকর্তা। কাজের ফাঁকে একদিন আদালত প্রাঙ্গনে চায়ের দোকানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। আর সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে উদঘাটিত হয়ে যায় নাটকীয় ওই খুনের রহস্য।

২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের লোহাগড়া থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটনের পর এমন তথ্যই জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। জানা যায়, প্রত্যন্ত গ্রামে পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডটির মূলহোতা মামলার বাদীরই আপন ভাই অর্থাৎ নিহতের চাচাত ভাই।

ঘটনার বিবরণে পিবিআই জানায়, নড়াইলের লোহাগড়া থানার নোয়াগ্রামের আমিরুল ইসলাম টনিক দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। ভালো অর্থ উপার্জন করে দেশে ফিরে স্থায়ী হয়েছেন বাড়িতে। ব্যবসা করবেন বলে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনেন তিনি।

পরবর্তীতে ব্যবসার উন্নতি দেখে আরো একটি গাড়ি কেনার জন্য ব্যাংক থেকে ১২ লাখ টাকা তুলেন। সেদিন রাতে পাকা বাড়িতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলেন টনিক। আচমকা হালকা শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। এরইমধ্যে ‘তুই এখানে কি করিস’ বলে কাউকে তাড়া করে বাইরে নিয়ে যান। তবে কিছুক্ষণ পর কিছুটা দূরে খুঁজে মাথায় মারাত্নক জখম নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পাওয়া যায় টনিককে। তখনই ব্যাটারিচালিত অটোরিশায় করে তাকে জেলা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে পাঠানো হয় খুলনায়।

পরে আহত টনিককে তার মা জিজ্ঞাসা করেন- চোর তো মনে হয় চিনেছো, কে এমন সর্বনাশ করলো। আহত টনিকের উল্টো জবাব-আগে ঘরে ফিরি। তারপর দেখ কি করি। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ দিন ডাক্তার-নার্সদের সব চেষ্টা বিফল করে টনিক মারা যান।

নিহতের পরিবারের পক্ষে থানায় খুনের মামলা দায়ের করেন টনিকের চাচাতো ভাই লাবু শেখ। যার খুনি-চোররা সবাই অজ্ঞাত। প্রায় দুই বছর বিভিন্ন সংস্থা ঘুরে মামলার তদন্তের ভার যায় পিবিআইতে। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তার কাছে শুধু এতটুকুই তথ্য- চোর টনিকের পরিচিত হতে পারে, আর এ ভরসায় এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করেন তিনি।

কোনোভাবেই রহস্যের কুলকিনারা করতে না পারা তদন্তকারী কর্মকর্তা একদিন আদালত পাড়ার একটি চায়ের দোকানে বসেন। ভিড় কমলে তদন্ত কর্মকর্তা কী মনে করে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেন তিন বছর আগের লোহাগড়ার কোনো খুনের বিষয়ে এখানে কোনো গল্প শুনেছেন কি-না।

দোকানদার স্মৃতি হাতরে বলার চেষ্টা করেন, কোনো এক মামলার আসামি আদালতে হাজিরা দিতে এসে মাঝে-মধ্যে তার দোকানে চা খেতেন। সেই আসামি একদিন সতীর্থ একজনকে কথাচ্ছলে বলেছিলেন তার জেলখানায় থাকাকালীন সেখানকার এক চোরের গল্প। সেই চোর চুরি করার সময় গৃহকর্তা তাকে চিনে ফেলায় হাতে থাকা দা দিয়ে কোপ মারে। কোপ খেয়েও তাকে তাড়া করে প্রায় ধরে ফেলেছিলেন।

চা দোকানির গল্পকে পুঁজি করেই ছুটতে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জেলখানার জামিনপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তিকে পাওয়া যায়। তার বাড়ি অন্যত্র হলেও আনা হয় যশোরে। যদিও সে কোনোভাবেই টনিকের খুনের সঙ্গে জড়িত নয়, তবে জেল কর্মীদের সাহায্য নিয়ে শনাক্ত করা হয় তার গল্পের সেই চোরকে। সে অন্য একটি মামলায় জেলে আছেন এবং নাবালক। তদন্তকারী দল আবিষ্কার করে এ হাজতি টাবু শেখ টনিকের আপন চাচাতো ভাই এবং মামলার বাদী লাবু শেখের আপন ভাই।

পিবিআই সূত্র জানায়, টাবু শেখকে খুঁজে পেয়ে তদন্তে গোলমাল বেধে যায়। সন্দেভাজন টাবু শেখ নাবালক হওয়ায় তার রিমান্ড আর পাওয়া যায় না। ওদিকে লাবু শেখ তদন্তে অসহযোগিতা শুরু করেন। টনিকের মাও ধাঁধায় পড়ে যান। তিনি আদালতে গিয়ে বলেন, তার ছেলে হত্যায় পিবিআই শুধু শুধু তার পরিবারের লোকজনকে ফাঁসাচ্ছে।

তদন্তকারী কর্মকর্তা অন্য পন্থা অবলম্বন করতে থাকেন। খুঁজে বের করা হয় টাবু শেখের বন্ধু-বান্ধবদের। একে একে গ্রেফতার করা হয় চারজনকে। যারা সবাই আদালতে স্বীকার করেন, টনিকের ব্যাংক থেকে উঠানো ১২ লাখ টাকার জন্যই টাবু শেখসহ টনিকের ঘরে ঢুকেছিলেন।

অবশেষে আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, টাবুর খাটের নিচ থেকে খুনে ব্যবহৃত দা-টি উদ্ধার করা হয়। ঘটনার তদন্ত শেষে আদালতে জড়িতদের বিরুদ্ধে খুনসহ ডাকাতির অভিযোগ আনেন পিবিআইর কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর