কৃষিপণ্য উৎপাদনে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা প্রয়োজন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ চাহিদার মাত্রার বিপরীতে সরবরাহের পরিমাণের ওপর কোনো পণ্যের মূল্য নির্ভর করে। চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ কম-এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের মূল্য বাড়ে। অধিক মূল্য দিয়ে পণ্য কিনতে হলে ভোক্তা চাপে পড়েন। আবার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে পণ্যের মূল্য কমে যায়। তখন উৎপাদক ক্ষতিগ্রস্ত হন। কাজেই চাহিদা ও সরবরাহের ভেতর ভারসাম্য বজায় থাকা প্রয়োজন, যাতে ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারেন; অন্যদিকে বিক্রেতাও পরিমিত মাত্রায় লাভবান হন। আমাদের দেশে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহে এই ভারসাম্য প্রায়ই থাকে না। কোনো কৃষিপণ্য অধিক উৎপাদিত হলে বাজারদর পড়ে যায়। তখন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিপরীতে কোনো পণ্যের জোগান কমে গেলে ভোক্তাদের চড়ামূল্য গুনতে হয়।

একজন কৃষক লাভের আশায় চাষবাষে প্রবৃত্ত হন; কিন্তু তিনি ফসল উৎপাদন করে আদৌ লাভবান হবেন কিনা, সে নিশ্চয়তা নেই। হয়তো তার মতো এত বেশি সংখ্যক কৃষক একই ফসলের চাষে ঝুঁকেন যে, অধিক উৎপাদনের দরুন ওই পণ্যের বাজারদর পড়ে যায়। তখন উৎপাদন খরচও আর উঠে না। বাজারে অন্য ফসলের উচ্চমূল্য দেখে সেটা চাষ না করায় কৃষককে তখন আফসোস করতে দেখা যায়। কৃষিপণ্যের বাজার যেন এক জুয়ার দান। কখন কোন পণ্যের মূল্য বাড়বে আর কখন কমবে, আগেভাগে তা বোঝা মুশকিল।

আমাদের দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য যেমন-খাদ্যশস্য, ডাল, শাকসবজি, মসলা, ফল, ফুল এ রকম কয়েকটি শাখায় ভাগ করা যায়। এর ভেতর খাদ্যশস্য, ডাল ও মসলাজাতীয় কৃষিপণ্য সহজে নষ্ট হয় না। কাজেই উৎপাদনের পরপরই উচিত মূল্য পাওয়া না গেলে বাজারদর ওঠার অপেক্ষায় একটা সময় পর্যন্ত এসব পণ্য রেখে দেওয়া যায়। অবশ্য গরিব কৃষক অর্থের টানাটানির ভেতর থাকেন। তার পক্ষে এই অপেক্ষা সম্ভব হয় না। সংরক্ষণযোগ্য কৃষিপণ্য একটা সময় পর্যন্ত রেখে দিলে পরবর্তী সময়ে মূল্য বাড়লে বিক্রি করা যায়। অন্যদিকে শাকসবজি, ফল, ফুল এসব পচনশীল কৃষিপণ্য। আমাদের দেশে আলু ছাড়া আর কোনো কৃষিপণ্য হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে এসবের বাজার মূল্য যা-ই হোক না কেন, ক্ষেত থেকে উঠিয়েই বাজারে বিক্রি করতে হয়।

গেল শীত মৌসুমে এক কেজি সিম ৫ টাকা এবং একই মূল্যে একটি ফুলকপি বিক্রি হয়েছিল। ২ মাস আগেও ১০ টাকা কেজি দরে বেগুন পাওয়া গেছে। অথচ এখন বেগুন ৫০ টাকা কেজি। বলা বাহুল্য, বেশি সস্তায় পণ্য বিক্রি করলে কৃষকের উৎপাদন খরচ ওঠে না। বাজারে মুলা নিয়ে গিয়ে কৃষক বেচতে না পারায় রাস্তার ধারে ফেলে গেছেন-শীত মৌসুমে প্রায়ই এ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে, আলু ও পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়ায় গত বছর এ দুটি পণ্যের মূল্য খুব বেড়ে গিয়েছিল। প্রশাসনিক উদ্যোগে তখন মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ীদের শাস্তির ভয় দেখিয়েও সে চেষ্টা সফল হয়নি। চাহিদা থেকে উৎপাদন কম হওয়ায় রমজানে তরমুজ সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে ছিল।

যশোর অঞ্চলে গত দুই দশকে ফল চাষের প্রবণতা বেড়েছে। আগে ঝোঁকটা ছিল আম চাষের দিকে। এখন আম চাষ আর লাভজনক হচ্ছে না। ফলে আমবাগান কমছে। কুল চাষ আর করবেন কিনা, অনেক চাষির ভেতর সেই দ্বিধা। পেয়ারা চাষও করছেন অনেকে। ইদানীং দেখছি, অনেক ড্রাগনের ক্ষেত। ড্রাগন চাষ বেশ ব্যয়বহুল। প্রতিটি গাছে পাকা খুঁটি দিতে হয়। এক বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষে ৫০-৬০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। দেশে এ ফলের চাহিদা কী পরিমাণ, কে জানে? অন্যত্রও চাষিরা একই চাষে ঝুঁকলে এই ফলের মূল্য পড়ে যাবে, চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

দেশে কোনো কৃষিপণ্যের কী পরিমাণ চাহিদা আছে এবং সম্ভাব্য কী পরিমাণ উৎপাদন হতে যাচ্ছে, আগেভাগে সেটি জানা সম্ভব হলে কৃষক সেই ফসল চাষে নামা কিংবা না নামার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আগাম সেই বার্তা দিয়ে কৃষককে সহযোগিতা করা গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতেন না। অন্যদিকে বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহের ভেতর ভারসাম্য বজায় থাকলে ভোক্তাও নায্যমূল্যে পণ্যটি কিনতে পারতেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আমরা সম্ভবত এ কাজটি করতে পারি। বিষয়টি হবে অনেকটা আবহাওয়া অফিসের আগাম আবহাওয়া বার্তা দেওয়ার মতো। সমুদ্রগামী জেলেরা যেমন আবহাওয়া বার্তা জেনে সাগরে যাবেন, কী যাবেন না-তা ঠিক করেন; তেমনি কৃষকরা উৎপাদন প্রবণতার বার্তা জেনে কোনো ফসল চাষ করবেন কী, করবেন না-সেই সিদ্ধান্তে আসবেন।

কৃষিপণ্য উৎপাদনের আগাম তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রস্তাবটি হলো-কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ‘কৃষিপণ্য উৎপাদন পূর্বাভাস’ নামে একটি অ্যাপ চালু করবে। এই অ্যাপে প্রতিটি কৃষিপণ্যের পাশে একটি আনুভূমিক মোটা রেখা সম্ভাব্য উৎপাদন নির্দেশ করবে। ধরা যাক, দেশে একটি ফসল ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হলে উৎপাদিত পণ্য বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এর চেয়ে বেশি জমিতে চাষ হলে কৃষকের লাভের সম্ভাবনা থাকে না। আর ওই ফসলের চাষ ৫০ হাজার হেক্টর জমির উপর উঠলে অধিক উৎপাদনের দরুন পণ্যটির বাজার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। চাষ মৌসুমে প্রতিদিন কী পরিমাণ জমি একটি ফসল চাষের আওতায় আসছে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য উৎপাদন মূল্যের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, সেই সমীকরণের ফলাফল আগেভাগে উপস্থাপন করা গেলে কৃষকের পক্ষে সঠিক চাষের ফসল নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এই অ্যাপের কাজ হবে, প্রতিদিন গ্রাফের ভিতর দিয়ে সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ বাজারের অবস্থা উপস্থাপন করা। ফসল চাষ মৌসুমের সূচনায় উৎপাদন রেখা হবে গাঢ় সবুজ রঙের। এরপর চাষ মৌসুম যত এগোবে, বেশি জমি চাষের আওতায় আসবে; ততই উৎপাদন রেখা প্রসারিত হতে থাকবে। সেই সঙ্গে সবুজ রংটাও ফিকে হয়ে আসবে। এর মানে হলো, একটি ফসল কম জমিতে চাষ হলে উৎপাদন কম হবে। তখন উৎপাদনে কৃষক বেশি লাভবান হবেন। আর চাষের জমির পরিমাণ বেড়ে গেলে উৎপাদনও বাড়বে। ফলে বাজারদর পড়ে যওয়ার দরুন কৃষকের কম মূল্য পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিবে।

উদাহরণে উল্লেখিত ফসলটি ৪০ হাজার হেক্টর পর্যন্ত জমিতে চাষ হলে উৎপাদন রেখা সবুজ থাকবে। এর চেয়ে জমির পরিমাণ বাড়লে, ফসল চাষ লাভ-ক্ষতির সন্ধিক্ষণে দাঁড়ালে উৎপাদন রেখা হলুদ রং ধারণ করবে। হলুদ রঙের অংশটুকু ফিকে থেকে গাঢ় হবে। আর ৫০ হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে চাষ হলে উৎপাদন রেখা লাল রং ধারণ করবে। তখন কৃষক ওই ফসল চাষে নামলে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং ইতোমধ্যে যারা চাষ করেছেন তারাও ক্ষতিতে পড়বেন। এ পর্যায়ে যত অধিক জমিতে চাষ হবে, উৎপাদন রেখা প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি লাল রং ততই গাঢ় হতে থাকবে। কোনো চাষি ফসল তালিকায় গিয়ে তখন পর্যন্ত উৎপাদনের সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ জেনে চাষের ফসল নির্বাচন করবেন। পণ্যের পাশের উৎপাদন রেখা লাল রঙের দেখলে স্বভাবতই তিনি ওই ফসল বাদ দিয়ে সবুজ রেখার কোনো ফসল নির্বাচন করবেন। ঢাকা শহরে পিক আওয়ারে গন্তব্যে যেতে আমরা যেমন ইন্টারনেটে রাস্তার জ্যামের অবস্থা জেনে নিই। রাস্তা লাল রঙের দেখলে গন্তব্যে যাওয়ার বিকল্প পথ খুঁজি।

প্রশ্ন হলো, তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার কাজ কিভাবে সম্পন্ন হবে? এ কাজ খুব সুষ্ঠু এবং সুচারুভাবে চাষ মৌসুমে প্রতিদিন সম্পন্ন করতে হবে। ইউনিয়নে ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। তিনি সাধারণত কোন মৌসুমে ওই ব্লকে কতটুকু জমি কোন চাষের আওতায় এসেছে, সে হিসাব সংগ্রহ করে থাকেন। সাধারণত চাষ মৌসুমের শেষে এই হিসাব সম্পন্ন হয়। অ্যাপ চালু হলে প্রতিদিন কতটুকু জমি কোন ফসলের আওতায় আসছে, সেই হিসাব প্রতিদিনই আপলোড করতে হবে। এ কাজে প্রতিটি ইউনিয়নে ২-৩ জন জরিপকর্মী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। উপজেলা ও জেলা কৃষি কর্মকর্তা হয়ে সংগৃহীত তথ্য দিনের পর দিন কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে জমা হবে। এ তথ্য প্রক্রিয়াজাত হয়ে সম্ভাব্য উৎপাদন রেখায় প্রদর্শিত হবে। এজন্য বিশেষ ধরনের সফটওয়্যারের প্রয়োজন পড়বে। দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। ২৪ ঘণ্টার ভিতর দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া যায়। এখন পুরা বাংলাদেশকেই কৃষিপণ্যের একটা বাজার ধরা যায়। সে কারণে দেশের মানুষের মোট চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদিত পণ্যের হিসাব কষলে তেমন বিচ্যুতি ঘটবে না।

কারও কারও কাছে বিষয়টি ‘আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নেওয়া’ অর্থে প্রচলিত বাগধারাটির কথা মনে হতে পারে। কিন্তু দূরদর্শী আদার ব্যাপারির ব্যবসার ভবিষ্যৎ বুঝতে জাহাজের খবর নেওয়াটাই সঙ্গত। ব্যাপারির পুঁজি সামান্যই। ব্যবসায়ে মার খেলে তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েন। সে কারণে জাহাজে আদা আসছে জানলে হিসাবি ব্যাপারি মাল খালাসের আগেই বাজারে আদা ছেড়ে দেন। অন্যদিকে জাহাজে আদা না এলে আদা জমিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উঁচুমূল্যে আদা বেচেন।

তথ্যই শক্তি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি তথ্য সার্ভিস নামে একটি বিভাগ আছে। এখান থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ‘কৃষিপণ্য উৎপাদন পূর্বাভাস’ অ্যাপ পরিচালিত হতে পারে। বীজ বপন, কী চারা রোপণের প্রাক্কালে ভবিষ্যতে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারের এই পূর্বাভাসদান ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

শরীফুজ্জামান আগা খান : শিক্ষক ও গবেষক

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর