নারী ও শিশু নির্যাতন: উত্তরণের ভাবনা

ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপিঃ এক বছর ধরে নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত সহিংসতা নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা চলছে। ধর্ষণসহ একের পর এক পৈশাচিক খবরে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে দেশের আপামর জনগণ স্তম্ভিত। মাঝে মাঝে মনে হয়, মুষ্টিমেয় নরপশুর হাতে যেন সভ্য সমাজ জিম্মি হয়ে পড়েছে। দেশজুড়ে অনেক প্রতিবাদ ও মানববন্ধন হয়েছে, লেখালেখি হচ্ছে। এসব গা শিউরে ওঠা পৈশাচিকতার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।

আমরা যদি বাংলাদেশের অর্জনের দিকে তাকাই, তাহলে অবাক হতে হয়। জেন্ডার সমতা, নারীশিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রভৃতি ব্যাপারে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। এই উন্নয়নের পেছনের প্রধান চালিকাশক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা—এ সত্যকে এখন আর ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করার প্রয়োজন নেই। আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় এবং পরিসংখ্যানেও এটি সুবিদিত। মহান জাতীয় সংসদসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও নারীদের একটি অংশ এখনো অবহেলিত, নিষ্পেষিত, নিপীড়িত। প্রায়ই আমার এলাকা কিশোরগঞ্জ ও হোসেনপুরের অসহায় নারীদের ফোন পাই। সংসদ সদস্য হিসেবে যতটুকু পারি বিভিন্ন খাত থেকে তাদের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করি। তাদের অনেকেই বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা। বোঝা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কী অসহায় জীবন যাপন করতে হয়! যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার অনেক নারী ও শিশুই এ ধরনের অসহায় পরিবার থেকে আসা এবং তাদের অনেক ঘটনাই অন্তরালে থেকে যায়।

মূল আলোচনায় ফিরে আসি। ফেনীর সাহসী তরুণী নুসরাতের হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে কাঁদিয়েছে। নুসরাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীরা ধরা পড়েছে এবং নিম্ন আদালতের বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। তার পরও দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছিল এবং তাদের সাজা আরো কঠোর করার দাবি উঠেছিল। আমার মতো অনেকেই তখন আশা করেছিলেন, নুসরাত হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ের পর হয়তো ধর্ষণ এবং নারী-শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন কিছুটা হলেও কমে আসবে। কিন্তু সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় এবং বেগমগঞ্জের অসহায় গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজ দেখে। এসবের শেষ কোথায়? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এরই মধ্যে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। আমি আশাবাদী, এ আইন ধর্ষণের মতো যৌন অপরাধ কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

দ্রুততম সময়ে কঠোর শাস্তি দেওয়া গেলে অপরাধ কমবে। আশির দশকে এসিড সন্ত্রাস মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরে শাস্তির পরিমাণ মৃত্যুদণ্ড এবং এসিডের সহজলভ্যতা দূর করার ফলে ধীরে ধীরে এই সন্ত্রাস কার্যত বন্ধ হয়। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন একটি জঘন্যতম অপরাধ; কিন্তু এর বিচারপ্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, জটিল ও অত্যন্ত সংবেদনশীল। কঠোর শাস্তি দিতে হলে সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ করা আবশ্যক। এসিড সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে স্পষ্ট আলামত থেকে যায়; কিন্তু যৌন নির্যাতন একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। মানসিক ট্রমার কারণে ভিকটিম অনেক সময় আলামত নষ্ট করে ফেলে। আইনের দীর্ঘসূত্রতা, সামাজিক ও পারিবারিক চাপ প্রভৃতি কারণে ধর্ষিতা ও তার পরিবার পিছিয়ে যায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়।

গত ১৫ অক্টোবর বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জানলাম, ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালতে নারী নির্যাতনের মামলা ঝুলে আছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৫৫১টি। বেশির ভাগই ধর্ষণের মামলা। প্রায় একই সময়ের আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাত্র ৩ শতাংশ ধর্ষককে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এটিই রূঢ় বাস্তবতা। বিচারপ্রক্রিয়াকে আরো সহজ ও দ্রুত করা গেলে আশা করা যায় এ অবস্থার উন্নতি হবে।

আমাদের ভাবতে হবে, কিভাবে যৌন সহিংসতা ঘটার আগেই দমন করা যায়। অনেক ধর্ষকদেরই নারীদের প্রতি একটি আগ্রাসী মনোভাব থাকে। নারী-শিশুরা যেহেতু অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তাই তারা আক্রমণের শিকার হয়। আবার অনেকে অসৎ রাজনৈতিক শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় কিংবা আর্থিক প্রতিপত্তির জোরে দুর্বল ও অসহায় নারীদের সুযোগ বুঝে লাঞ্ছিত করে। এই শ্রেণির অপরাধীদের ভেতর এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে। কর্ম-অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নেতিবাচক মনোভাব দূর করা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। যেটা আবশ্যক তা হলো, সামাজিকভাবে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেন ধর্ষকের জন্ম না হয়। যেন নতুন প্রজন্ম বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তা নিয়ে বড় হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে নারীর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তা প্রধানত দুই ধরনের। হয় অপরাধীরা অধীন কোনো নারীকে আক্রমণ করেছে যেমন নুসরাতের ঘটনা; অথবা এটি একক কিংবা ক্ষুদ্র একটি দলের মানসিক বিকৃতির বহিঃপ্রকাশ—যেমনটি ঘটেছিল বিমানবন্দরের কাছাকাছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ক্ষেত্রে। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশে ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজরা অনার কিলিংকে সমর্থন করে এবং সুযোগ পেলেই নারীশিক্ষার বিরোধিতা করে। বাংলাদেশে জাতপাতের বালাই নেই। সুতরাং আমাদের সমাধান কিছুটা সহজতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে তিন ধরনের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। অনেকটা সেই আদলে বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হলে আমাদের আরো দ্রুততার সঙ্গে বহুমাত্রিক পরিবর্তন চালিয়ে যেতে হবে।

প্রথমত, স্কুলের পাঠ্যসূচিতে লিঙ্গ সমতা এবং নর-নারীর মধ্যে যে শাশ্বত প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে সে ব্যাপারে যুগোপযোগী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। ছেলে-মেয়ে যে পরস্পরের পরিপূরক তা শেখানোর জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগানো দরকার। তাহলে নারী-শিশু নির্যাতনসহ অনেক ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব। তৃতীয়ত, সব ধরনের প্রচারমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া দরকার। উপযুক্ত জনসচেতনতামূলক প্রচার প্রতিটি টিভি চ্যানেলে অত্যাবশ্যক করা যেতে পারে। ধর্ষণে ধর্ষিতার কোনো অপরাধ নেই—এ সত্য ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।

প্রথমেই বলেছি, আমার এ লেখা নারী হিসেবে নিজের অনুভূতির কিছুটা বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক সমাজব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে, প্রত্যেক নাগরিকের সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার করা। বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গের কারো সঙ্গে কথা বলা বা কোনো ধরনের মিটিং করার সময় অধিকতর সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। আজকাল উন্নত দেশে বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রেই প্রতিটি কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে কয়েক বছর পর পর Sexual Harassment, Use of Appropriate Words at Work, Racial Discrimination প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একটি সামাজিক সমস্যা দূর করতে হলে ব্যাপক সামাজিক প্রচার এবং সবার অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। নারী নির্যাতনকারীরা যখন বুঝবে তাদের পালানোর কোনো পথ নেই, কোনো শক্তিধর অপশক্তি তাদের আশ্রয় দেবে না, তখনই ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন কমবে। এ কাজে বাংলাদেশ অবশ্যই সফল হবে।

লেখক : সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ-১; সদস্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর