প্রশংসায় ভাসছেন মানবিক পুলিশ সার্জেন্ট সন্দীপ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পুলিশের সংকেত অমান্য করে পালিয়ে যাচ্ছিল একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ঘটনাটি ছিল রাজশাহী মহানগরীর রেলগেইট-শিরোইল বাস টার্মিনাল সড়কের।

হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা পুলিশ সার্জেন্টকে ধাক্কা মেরে প্রায় ১শ’ গজ দূরে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যান। পরে সড়ক বিভাজকের বেড়ার ওপর সার্জেন্টকে আছড়ে ফেলে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায় সেই চালক। এক পর্যায়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে ওই পুলিশ সার্জেন্ট জ্ঞান হারান। কিন্তু তিনি মরলেন না বাঁচলেন সেটি দেখতে তার দিকে ফিরেও তাকায়নি ওই বেপরোয়া অটোরিকশা চালক।

এ ঘটনার পর উধাও হয়ে যান ওই অটোরিকশা চালক। এরপর হাসপাতালে টানা ৩৫ দিন কাটিয়ে কাজে ফেরেন ভুক্তভোগী পুলিশ সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিক। তিনি রাজশাহী মহানগর ট্রাফিক পুলিশে কর্মরত। আর অভিযুক্ত অটোরিকশা চালকের নাম মাসুদ রানা (২৭)। তিনি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সাব্দিপুর এলাকার মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে। অনেক চেষ্টার পর একদিন আগেও তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তাই অমানবিক এ গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু ৮ এপ্রিল সকালে এ গল্পটি নতুন দিকে মোড় নেয়।

এদিন সকালে আবারও অটোরিকশা নিয়ে রাজশাহী মহানগরীর রেলগেইট এলাকায় আসেন চালক মাসুদ রানা। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় তাকে আটকে দেন দায়িত্বরত সার্জেন্ট রাশেদুল। অটোরিকশার কাগজপত্র জব্দ করা হয়। পরে মামলা লিখতে গিয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। জব্দ করা নথির সঙ্গে অটোরিকশার নম্বর প্লেটের কোনো মিল নেই শেষের ডিজিটও নম্বরপ্লেট থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।

এরপরই পুরোনো হিসেবের খাতা খোলে। হাতেনাতে ধরা পড়ে যান ওই অটোরিকশা চালক। কিন্তু তখনও অপরাধ স্বীকার করেননি মাসুদ। এ সময় অটোরিকশাটি নগর পুলিশের ট্রাফিক অফিসে নেওয়া হয়। সেখানে পুলিশের জেরার মুখে ঘটনার আদ্যপান্ত জানিয়ে আগের সব অপরাধ স্বীকার করেন অভিযুক্ত অটোরিকশা চালক মাসুদ রানা।

অভিযুক্ত মাসুদ রানা জানান, বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। এক সন্তানের বয়স চার বছর, অন্যজনের ছয় বছর। বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মাকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই সংসার চালাতে পারছিলেন না। এরপর ঋণের টাকায় কেনা অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেন দুই মেয়ের জনক মাসুদ।

ওই দিনের ঘটনা স্বীকার করে মাসুদ জানান, তার অটোরিকশাটি সবুজ রঙের। কিন্তু রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী দুপুর ২টা পর্যন্ত লাল রঙের অটোরিকশা চলাচল করবে মহানগরীতে। গত ২ মার্চ যাত্রী নিয়ে তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন। আগের যাত্রীদের নামিয়ে আরও কয়েকজন যাত্রী নিয়ে যান মহানগরীর রেলগেইটে। উদ্দেশ্য ছিল-সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে আবারও গোদাগাড়ী ফিরবেন। বেলা তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। রেলগেইট এলাকায় ঢুকতেই গাড়ি থামানোর সংকেত দেন একজন সার্জেন্ট। তিনি ভেবেছিলেন, গাড়ি আটকে দেবে। এতে তার সংসার চলবে না। কোনো কিছু না ভেবেই তিনি টান দিয়ে বাস টার্মিনালের দিকে এগিয়ে যান। সেখানে আরেক সার্জেন্ট তাকে আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকেও তিনি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে সড়ক বিভাজকের ওপর ফেলে দেন।

ভয়ে তিনি সেদিন কোনোরকমে পালিয়ে যান। পরে আর বের হননি রাস্তায়। শেষে বাধ্য হয়ে নম্বর প্লেট থেকে শেষের সংখ্যাটি মুছে দিয়ে আবারও রাস্তায় নামেন।

মাসুদ আরও স্বীকার করেন তিনি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন। এ ভুলের ক্ষমা নেই। কিন্তু সব শোনার পর তবুও পুলিশ সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিক তাকে ক্ষমা করে দেন। মাসুদ জীবনে আর এমন ভুল করবেন না। রাস্তায় তিনি আইন মেনেই চলাচল করবেন এ বলে মুচলেকা দেন।

এদিকে, সব শোনার পর মনের ক্ষত মুছে গেলেও সেই দিনের শরীরের ক্ষতচিহ্ন আজও মুছে যায়নি সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিকের। এখনও তিনি ঘটনায় আঘাত পাওয়া বাম হাতে শক্তি পান না। তিনি জানান, ধরা পড়ার পর তিনি গিয়ে ওই চালককে শনাক্ত করেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে তার পরিবারের দুরাবস্থার কথা জানতে পারেন। পরে মামলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি। ক্ষমা করে দেন অটোচালককে।

তিনি বলেন, ওই চালক দুই শিশু সন্তানের বাবা। তার নিজেরও দুই সন্তান আছে। মামলা হলে তাকে কারাবাস করতে হতো। কিন্তু দুটি সন্তান, আর বিধবা মাকে নিয়ে তার স্ত্রী অনিশ্চতায় পড়তেন। তার পুরো পরিবার ভেসে যেত। বিষয়টি তাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। শেষে মানবিক দিক বিবেচনা করে মামলার সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে আসেন।

সার্জেন্ট সন্দীপ আরও বলেন, পুলিশ সবসময় আইনের প্রয়োগ করে। অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করে অন্যদের শিক্ষা দেয়। এ চালকের ক্ষেত্রেও এমনটি করা যেত। যদিও চালক তার প্রতি মানবতা কিংবা সহানুভূতি দেখাননি। কিন্তু এরপরও তার আর বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।

সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিকের এ মহানুভবতাকে সম্মান জানিয়েছেন- রাজশাহী মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি ট্রাফিক) অনির্বাণ চাকমা। তিনি বলেন, ঘটনার পর দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তার মনে হয়েছে এটি নিছকই দুর্ঘটনা। পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে ঘটনা ঘটিয়েছে চালক। তাই মুচলেকা নিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ চায়, অপরাধের পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবন দিতে।

পুলিশ সার্জেন্ট সন্দীপ ও অটোচালক মাসুদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সব সময় কেবল সাজা দিয়েই মানুষকে সংশোধন করা যায় না। ভালো আচরণ ও ক্ষমা দিয়েও সংশোধন করা যায় বলেও উল্লেখ করেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর