আত্রাইয়ের ধুধু বালুচর এখন সবুজের সমারোহ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মোহাম্মদ আলম শেখ (৪০)। ভূমিহীন, অন্যের জায়গায় ছোট পরিসরে দুটো ছোট ছোট ঘর তৈরি করে স্ত্রী এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে বসবাস। দারিদ্রতার আর অভাবের মধ্যেই এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীসহ তাদের চারজনের সংসার। দিনমজুর, অন্যের বাড়িতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করেই তাদের সংসার চলে। ছেলে মেয়েরা বড় হইতেছে। ছেলে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে আর মেয়েটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চললেও সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেক কষ্ট করে দিনটি চালাতে হয়।

একদিন বাড়ি থেকে অভিমান করে বাড়ির পূর্ব দিকে হেঁটে হেঁটে আত্রাই নদীর জয়গঞ্জ ঘাটের তীরে বিশাল চরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো এই বিশাল বালুর চরে যদি কিছু একটা করা যায়। তবেই আমাদের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন হতে পারে। সেই চিন্তা চেতনা থেকেই দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ি নামা বনদিয়া পাড়ার জসিম উদ্দীনের ছেলে আলম শেখ সুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।

গত তিন বছর ধরে শুরু হয়েছে তার চিন্তা চেতনার বাস্তবায়ন করার কাজ। আত্রাই নদীর জয়গঞ্জ ঘাটের পশ্চিম পাড়ে ৭ একর বালুর চরে এখন সে মিষ্টি কুমড়া আর লাউ চাষের আবাদ করেছে। এক সময়ের ধুধু বালুর চর এখন সবুজের সমারোহ আর মিষ্টি কুমড়া, লাউ, রসুন, পেঁয়াজ, কাচা মরিচ, ভুট্টার আবাদ হওয়ায় আলম শেখের মত অনেক ভূমিহীন চাষির ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে।

আত্রাইয়ের ধুধু বালুচর এখন সবুজের সমারোহ

সেই বিশাল বালুর চরে এখন থোকায় থোকায় মিষ্টির কুমড়ার হলুদ হলুদ ফুল, ডগায় ডগায় মিষ্টি কুমড়া, লাউ গাছের সাদা সাদা ফুল আর ডগায় ডগায় লাউ। এসব সবজির ফলন দেখে আলম শেখ ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। ছেলে মেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে দেশের বড় কর্মকর্তার বানানোর স্বপ্নও দেখছেন তারা এখন।

চাষি মোহাম্মদ আলম শেখ জানান, বর্ষার সময় আত্রাই নদীর এপার ওপার পানিতে থৈ থৈ করে। পানি নেমে যাওয়ার পর নভেম্বরের শুরুর দিকে এই বিশাল বালুচরের মিষ্টি কুমড়া আর লাউ গাছ লাগানোর জন্য বড় বড় গর্ত করতে হয়। সেই গর্তের মধ্যে দোআঁশ মাটি আর গোবর সার এবং কিছু রাসায়নিক সার মিশিয়ে মিষ্টি কুমড়া আর লাউ এর বীজ বপন করতে হয়। সেই কুমড়ার বীজ থেকে আস্তে আস্তে চারা গাছগুলো বড় হতে থাকে।

আত্রাইয়ের ধুধু বালুচর এখন সবুজের সমারোহ

তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সেই মিষ্টি কুমড়া আর লাউয়ের ফলন আসতে শুরু করে। মার্চ মাস থেকেই লাউ আর এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই মিষ্টি কুমড়া পেকে যায়। লাউ স্থানীয় পাইকারদের নিকট বিক্রি করা হলেও মিষ্টি কুমড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় বড় মিষ্টি কুমড়া ব্যবসায়ীরা ক্রয় করতে আসে। সেই মিষ্টি কুমড়া ব্যবসায়ীরা ট্রাক ভর্তি করে মিষ্টি কুমড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে থাকেন। এই মিষ্টি কুমড়া এবং লাউ আবাদ করতে ৭ একর বিশাল চর এর মধ্যে ১ হাজার ৭ শত গর্ত খুঁড়া হয়েছে। মিষ্টি কুমড়ার গাছ লাগানোর পর থেকে মিষ্টি কুমড়া বাজারজাতকরণ করা পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। সব বাদ দিয়ে প্রায় প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা লাভ হয়।

একই ভাবে শেখ আলমের ভাবি আলেয়া বেগম জানান, তিনিও ভূমিহীন। স্বামী আছে, সংসার আছে, ছেলে মেয়ে আছে। স্বামীর সাথে তিনিও এই বিশাল বালুচরে তিন একর জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ ও লাউয়ের চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে।

তিনি বলেন, মিষ্টি কুমড়ার চাষাবাদ করতে পানি সেচ ছাড়া তেমন বেশি একটা খরচ হয় না। তবে লাউ আজ থেকে প্রায় এক মাস আগে থেকেই প্রতিদিন স্থানীয় বাজারে পাইকারি ভাবে প্রতিটি লাউ ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করছেন। প্রতিদিন ২ শত থেকে ৪ শত লাউ বাজারে বিক্রি করতে পারছেন। এতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ শত থেকে ১৮শত টাকা বিক্রি হচ্ছে।

আত্রাইয়ের ধুধু বালুচর এখন সবুজের সমারোহ

তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ করে এই আবাদ করলেও ঋণ পরিশোধ করেও বছরে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় হচ্ছে।

ঝাড়বাড়ি বাজারের ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী বলেন, আমাদের ঝাড়বাড়ি বাজারের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার এখন বালুর চরের মধ্যে আবাদ করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে এখন তারা স্বাবলম্বী। জয়গঞ্জ আত্রাই নদীর বিশাল চরে এক থেকে দেড়শ জন ভূমিহীন নিজস্ব মেধা শক্তি খাটিয়ে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে মিষ্টি কুমড়া, লাউ, রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, টমেটো, ভুট্টাসহ রবি শস্য আবাদ করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন নিজেরাই করছেন। পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কিংবা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ভূমিহীন কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নত মানের বীজ সরবরাহ করা যায়। তাহলে এই ভূমিহীন কৃষকেরা একসময় আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল হবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে দেশের উন্নয়নে অংশীদার হবে বলে বিশ্বাস করি।

স্থানীয় ইসমাইল হোসেন জানান, এক সময়ের ধুধু বালুচর এখন সবুজের সমারোহ, যেদিকে তাকায় চিকচিক সাদা বালুর মধ্যে এখন সবুজের সমারোহ দেখি। পাশাপাশি গৃহহীন ভূমিহীন মানুষেরা অনেকটাই স্বাবলম্বী। এই জয়গঞ্জ আত্রাই নদীর চরের বুকে সবুজের ক্ষেত। দূর থেকে দেখেই ভাল লাগছে ভূমিহীন চাষিরা নিজের ভাগ্য নিজেরাই পরিবর্তন করছে।

আত্রাইয়ের ধুধু বালুচর এখন সবুজের সমারোহ​

এক সময় মনে হত আত্রাই নদী আমাদের জন্য অভিশাপ। এখন মনে হচ্ছে আত্রাই নদীর সুবিশাল বালুর চর আমাদের গ্রামের ভূমিহীন চাষিদের জন্য আশীর্বাদের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। সেই বালুচরের মধ্যেই এখন সোনা ফলছে। কিছু ভূমিহীনদের কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি হয়েছে। ভূমিহীন কৃষকেরা সমবায়ের ভিত্তিতে একে অপরের জমিতে একে অপরের বালুচরের কাজ করে ভাগ্যের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের এবং জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি বলে আমি মনে করি।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক তৌহিদুল ইকবাল বলেন, আমাদের শুকনো মৌসুমে জেলার অনেক বড় বড় নদীর চর জেগে উঠে। জেলার উপর দিয়ে আত্রাই নদীর প্রবাহিত হয়ে কয়েকটি উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহমান। জয়গঞ্জ আত্রাই নদীর ঘাটের অনেক চর পড়ে আছে। সেই আত্রাই চরকে কাছে লাগিয়ে স্থানীয় ভূমি কৃষকেরা চাষাবাদের আওতায় নিয়ে এসেছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সুখবর। আমাদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ঐ সকল চাষিদেরকে আমরা বিআরটিএ মাধ্যমে রবি শস্য উৎপাদনের জন্য ভাল মানের বীজ সরবরাহ করে আরো উৎসাহ প্রদান করা হবে।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর