দখল-দূষণ ভরাটের কবলে চলনবিলের ২২ নদীই অস্তিত্বহীন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নদীটির নাম গোমতি। চলনবিলের বুক চিরে এই নদীর প্রবাহ। বাঘাবাড়ি থেকে উত্তর জনপদের প্রায় আটটি জেলাতে নৌ চলাচলের মাধ্যম এ নদী। এক সময়কার উত্তাল গোমতি এখন দখল-দূষণ আর ভরাটের কবলে। কেবল বর্ষা মওসুমেই এই নদীতে যৎসামান্য ছোট নৌকা চলাচল করে। আর শুস্ক মওসুম জুড়ে নদীর বুক জেগে উঠে।

তবে নদীটির যৌলুস ফেরাতে খনন কাজ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল নদীর প্রস্থ ও গভিরতা বৃদ্ধি এবং নাব্যতা ফেরানো। যাতে নৌচলাচলে গতি বাড়ে, বিল এলাকার মানুষ নদীর পানিতে সেচ সুবিধা পান এবং উন্মুক্ত জলরাশিতে মাছ শিকার করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এসবের কিছুই হয়নি। ‘নদী খনন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু নাব্যতা ফিরেনি’। খননের উচ্ছিষ্ট মাটিতেই আবার সংকুচিত হয়েছে নদী। শুধু যে গোমতি নদীর সাথে এমন নির্মমতা দেখানো হয়েছে তা নয়। খনন কাজ চলছে চলনবিলের আত্রাই, গুমানী, তুলশীগঙ্গা নদীর। প্রতিটি নদী খননেই এমন বৈরী আচরণ করা হয়েছে। কোন নদীই ঠিকঠাক খনন করা হয়নি।

স্থানীয়রা বলছেন, নদী খননের উচ্ছিষ্ট এই মাটি নদী তীর হতে ১ হাজার মিটার দূরে রাখার কথা। অথচ খননের মাটি নদীর দুই ধারে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। বান-বর্ষা সবই গেছে। ধুয়ে গেছে নদী তীরে রাখা মাটিও। সেই মাটিতেই আবার পলি পড়েছে নদীর বুকে। পাড় ঘেঁষে মাটির বাধ তৈরি হওয়ায় সংকুচিতও হয়েছে নদী। নদী খননে এমন দৃশ্যমান অনিয়ম করা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। শুধু খননে অনিয়ম নয়, দখল-দূষণ আর ভরাটের কবলে পরে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে চলনবিলের প্রায় ২২টি নদী। আজ বিশ্ব নদী রক্ষা দিবস। এসব খাল বিল নদী রক্ষা করতেই বিভিন্ন সংগঠন সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে মুশাখা, নন্দকুজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে বড়াল। প্রমত্তা বড়ালের উৎপত্তিস্থলে চারঘাট পৌরসভা ৪/৬শ ফিট নদী দখল করে দুইটি স্থাপনা নির্মাণ করেছে। চাটমোহর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সংলগ্ন আরও ৮শ ফিট নদী দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছে চাটমোহর পৌরসভা। এছাড়া পাবনার আটঘরিয়া থেকে বনপাড়া পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার নদী দখল করে সরকারি অফিসসহ ব্যক্তিমালিকানা বহু স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়েছে।

তাছাড়া প্রায় ৬শ ফিট প্রস্থের আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, তুলসি চেঁচিয়া, তুলশীগঙ্গা, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গাসহ প্রায় ২২টি নদীর দুইপাড় দখল করে বসতি নির্মাণ প্রক্রিয়া অব্যহত রয়েছে। ১৮টি খালের মধ্যে নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চলনবিলের ৩টি নদীর প্রস্থ নূন্যতম (৩০ মিটার) ৯৭ ফিট আর (২.৫ মিটার) ৮ ফিট গভীর করে খনন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই করা হয়নি। এছাড়া খননের মাটি বিক্রি করার পাশাপাশি নদীর দুই ধারে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। এতে নদীর সাথে বিলের বিস্তার পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ভাঙ্গুড়ার এরশাদ নগর থেকে গুরুদাসপুর রাবারড্যাম পর্যন্ত ৯৭ কিলোমিটারের আত্রাই নদীর খনন কাজেও ব্যপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

৯২ কোটি টাকা বরাদ্দে আত্রাই নদীর ৯৭ কিলোমিটার খনন কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং। এছাড়া গুমানি নদীর খনন কাজ করেছেন জেলে থাকা ক্যাসিনো সাহেদ। ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকল্প ইচার্জ ইয়াকুব আলী বলেন, তারা উপরের নির্দেশনা মোতাবেক ২.২ থেকে ২.৪ মিটার পর্যন্ত গভির করা হচ্ছে। তবে সব খানে খনন করা হচ্ছে না।

তবে নদী খনন দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএ’র সহকারি প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান নদী খননের ব্যপারে কোন তথ্য সরবরাহ করেননি। এ ব্যপারে কোন বক্তব্যও দেননি।

এদিকে ইম্পেরিয়েল গেজেট অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কি.মি. আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান নদী ৯টি, ২০টি খালসহ ছোট ছোট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। অতীতে ২৩ হাজারের মত বড় বড় পানির আধার ছিল। যা বেশীর ভাগই বেদখলকৃত ও হাত ছাড়া হয়ে গেছে।

চলনবিল রক্ষা কমিটির সভাপতি মানবাধিকার কর্মী অধ্যপক আত্হার হোসেন বলেন, এসব নদী ও খালের প্রায় সবই বেদখল হয়ে গেছে। তাছাড়া যেভাবে নদীগুলো খনন করা হচ্ছে তাতে প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে- প্রায় ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে।

পরিসংখ্যানমতে, প্রতি বছর ২২২১/২ মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রবেশ করে, ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বর্ষায় চলনবিল ত্যাগ করে।

পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, দেশের বৃহত্তম পদ্মা-যমুনা নদী এবং বিশাল জলাভূমির চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী বড়াল। এই নদী ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ৮০’র দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিত ভাবে নদীর উৎস মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিয়ায় স্লুইসগেট নির্মাণ, পাবনার চাটমোহরে তিনটি ক্রস বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ করে নদীটির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করেছে। সম্প্রতি ২২০ কিলোমিটারের বড়াল নদীটি উদ্ধার আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ সরকারের চলনবিল মৎস্য প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী- এক সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৮২ সালে মোট ১,৭৭,০৬১ জেলে এসব নদ-নদী ও খাল জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। পর্যায়ক্রমে কমতে কমতে ২০০৬ সালে এর সংখ্যা ৭৫,০০০ জনে দাঁড়ায়।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু রায়হান বলেন, নদী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে। তাছাড়া বড়াল, নারদ ও মুসাখা নদীর খনন কাজ অল্প দিনেই শুরু হবে।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর