সুস্থ সমাজ গড়তে জনসচেতনতা তৈরিতে মিঠামইন থানা পুলিশ

রফিকুল ইসলামঃ মাদক, নারী সহিংসততা ও সাম্প্রদায়িকতাসহ সামাজিক ব্যাধিসমূহ প্রতিরোধকল্পে জনসচেতনতা তৈরি করতে এবং আইন ও পুলিশী সেবা ইউনিয়ন ভিত্তিক বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থানা পুলিশ আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মো. হাবিবুর রহমান বিপিএম.পিপিএম বার ও জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম বারের নির্দেশনায় পুলিশ-জনতার মধ্যে আরো দৃঢ়বন্ধন স্থাপন এবং অবৈধ ও অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এ জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে পুলিশ প্রশাসন জানায়।

প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশে মানুষ ব্যক্তিত্বের মধ্যে অসুস্থ প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে সমাজিক ব্যাধির জন্ম হচ্ছে। যেমন- যৌন নিপীড়ন, ইভটিজিং, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, প্রতারণা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, গুজব, যৌতুক, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি।

এছাড়া বাঙালি আবহমানকালের যে কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, নিষ্কলুষ মূল্যবোধ ও চারিত্রিক স্বকীয়তার যে অবক্ষয়, তা প্রতিরোধে বড় চিকিৎসক একমাত্র পুলিশ বা প্রশাসন নয়, এমন কি সরকারও নয়- সমাজও। বিদ্যমান অথচ নিষ্ক্রিয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুলিশের পাশাপাশি কিছুকিছু দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করছেন।

মিঠামইন থানার ওসি মো. জাকির রব্বানী জানান, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে একজন এসআই, একজন এএসআই ও দুজন কনস্টেবলের সমন্বয়ে একেকটি বিট গঠন করা হয়েছে।

তিনি জনস্বার্থে খোলাসা করে জানান, গোপদিঘী ইউনিয়ন বিটের দায়িত্বে রয়েছেন এসআই মো. নূরুল হুদা, মিঠামইন সদর ইউনিয়নে এসআই মো. নজরুল ইসলাম, ঢাকী ইউনিয়নে এসআই গণেশ চন্দ্র শীল, ঘাগড়া ইউনিয়নে এসআই মো: আল মামুন, কেওয়ারজোড় ইউনিয়নে এসআই প্রভাত কর্মকার, কাটখাল ইউনিয়নে এসআই মো: মাসুদ মিয়া ও বৈরাটি ইউনিয়নে এসআই শেখ জিয়াউল রাব্বি।

জনসাধারণের ভোগান্তি কমাতে প্রত্যেকেই সততা ও নিষ্ঠার সাথে সেবা দিয়ে যাবেন বলে উল্লেখ করেন ওসি রব্বানী বলেন, কেউ বিপদে 999 নাম্বারে যোগাযোগ করলে পুলিশ হাজির থাকবে জনতার পাশে।

‘পুলিশ হবে জনতার’ মন্তব্য করে পুলিশের প্রতি ইতিবাচক ধারণা বাড়াতে গতকাল জুম্মার দিন বা শুক্রবার প্রতিটি বিটে থাকা পুলিশ অফিসারেরা প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর মসজিদে মসজিদে গিয়ে সামাজিক ব্যাধিসমূহ তুলে ধরে চরিত্র গঠন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও অবক্ষয় রোধে জনসচেতনতামূলক বক্তব্য রাখেন বলে সূত্র জানায়।

গতকাল শুক্রবার (৫ মার্চ) বৈরাটি ইউনিয়নের বাহেরচর জামে মসজিদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ওসি মো. জাকির রব্বানী উপস্থিত কিশোর-তরুণ, যুবা-বৃদ্ধ মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধির নামোল্লেখ করে বলেন, সাম্প্রতিককালে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে মাদক ও মাদকাসক্তির বিস্তার সংক্রমক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। মাদকের মধ্যে গাঁজা, ভাং, বাংলা মদ, তাড়ি ইত্যাদি। এছাড়াও ফেন্সিডিল, পেথেড্রিন, ইয়াবা, মরফিন ও হেরোইন নামে নিত্যনতুন নামে তরুণ-তরুণীরা নেশার জালে আটকা পড়ছে। হাজার প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনেও নেশার ছোবল থেকে আসক্তদের ফেরানো যাচ্ছে না। দারিদ্র্য পীড়িত এলাকায়ও মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ছে। এদেরকে চিরুনি অভিযানে টুকিয়ে টুকিয়ে ধরতে পুলিশ বদ্ধ পরিকর বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

ওসি রব্বানী এসব রোধে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি জোর দিয়ে বস্তুত ‘পরকাল ভাবনা মানুষের কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে’ উল্লেখ করে বলেন, মানুষের ভেতরের সুপ্রবৃত্তি ও সদগুণাবলি আখিরাতকে জাগিয়ে তুলে।

তিনি আরো বলেন, মানুষের সুকুমার বৃত্তির ওপর পর্দা ফেলে ক্ষণিকের বস্তুকে মজিয়ে রাখে। যার মধ্যে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয় কিংবা পরকালের ভাবনা কাজ করে না, তাকে কেবল আইন দিয়ে নিবৃত্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক সব অপরাধ দমনে অন্যতম উদ্যোগের পাশাপাশি সব চাইতে বেশি কার্যকর নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সবার ভেতর ধর্মীয় অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়া।

উপজেলা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে এসআই মো. নূরুল ইসলাম অন্যসব সামাজিক ব্যাধি বর্ণনা করে বলেন, মাদকাসক্তি হলো মরণ-নেশা। এর কুফল অতি মারাত্মক বলে বিবেচনা করা হয়। বিশেষত এ কারণে যে, মাদকাসক্তির প্রভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে অধপতন নেমে আসে। যুবকশ্রেণির নৈতিক ঙ্খলনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়।

গোপদিঘীর ভূঁইয়া বাড়ি কাচারি জামে মসজিদে এসআই মো. নূরুল হুদা সামাজিক ব্যাধির আদ্যপ্রান্ত উল্লেখ করে বলেন, অবৈধ মাদকের ব্যবহার এবং অপরাধ হাত ধরাধরি করে চলে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা নেশার খরচ জোগানোর জন্যই নানারকম সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে- চুরি-চামারি, ছিনতাই, নারী সম্ভ্রম হরণ, চাঁদাবাজি, মাদক বেচা ইত্যাদি।

এ বিষয়ে সচেতনতার পাশাপাশি পুলিশকে তথ্যসহ সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রতিটি ইউনিয়নে বিট পুলিশিংয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসাররা উদাত্ত আহ্বান জানান এবং পুলিশী সেবা নিতে টাকাকড়ি আদায়ের কোনো অবকাশ নেই বলে ওসি রব্বানী দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন।

মিঠামইন উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আছিয়া আলম বলেন, সংক্রমকই ব্যাধি, স্বাস্থ্য নয়। আমরা নারী সহিংসতা ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়বো। মহামান্য রাষ্ট্রপতির এলাকা কীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি উপজেলা পরিষদও সোচ্চার রয়েছে।

তিনি পঙ্কিলতা ছেড়ে জাতীয় জীবনে তরুণ ও যৌবনশক্তিকে আহ্বান জানিয়ে কবি সুকান্তের ভাষায় বলেন- ‘এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়/পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে, এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়- /এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।’

এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাশরুকুর রহমান খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব না হওয়ায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো: মিজানুর রহমানের বক্তব্য নেয়া হয়।

তিনি সমাজকে সুগঠিত করতে এবং জনসাধারণ বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে নীতিজ্ঞান ও সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে মন্তব্য করে বলেন, সচেতন হলে কোনো রকম অন্যায় কুমন্ত্রণা তাদের বশীভূত করতে পারবে না।

এদিকে সুশীল সমাজ বিট পুলিশিংয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানায়, সমাজে ‘হোয়াইট ক্রিমিনালদের’ দৌরাত্ম্য বড়বেশি বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা ‘খাইট্টা লাগাচ্ছে আর আইট্টা গিয়া ভাইঙা দিয়া আসছে’। তাদের বিচরণ সর্বত্র। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা গেলে অপরাধ কমতো এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় শান্তি ফিরে আসতো।

সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়।  

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর