ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারী জাগরণে রোকেয়ার ভূমিকা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ধর্মের পক্ষে যত না ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন ধর্মের বিপক্ষে। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রবল বিরোধিতা করেছেন, করেছেন ইসলামী অনুশাসনের তীব্র সমালোচনাও। তিনিই এই উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী যিনি ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ করেছিলেন একই সঙ্গে। কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থকে নয়, বরং সকল ধর্ম ও তার ধারক-বাহক-প্রহরীরূপী পুরুষকে আক্রমণ করেছেন। ‘আমাদের অবনতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভা-বলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে দেবতা কিম্বা ঈশ্বর-প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন এবং অসভ্য বর্বরদিগকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন!’

রোকেয়া আরও বলেছেন,
‘… এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। কিন্তু স্ত্রীলোকদের সেরূপ যোগ্যতা কই যে মুনি-ঋষি হইতে পারিতেন? যাহা হোক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত কি-না তাহা কেহই নিশ্চিত বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোনো দূত রমনী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধ হয় না এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া- ‘রমণীজাতিকে নরের অধীন থাকিতে হইবে’- ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর? আমেরিকায় কি তাহার রাজত্ব ছিল না? ঈশ্বরদত্ত জলবায়ু তো সকল দেশেই আছে, কেবল দূতগণ সর্বদেশময় ব্যাপ্ত হন নাই কেন? … এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহা উচিৎ নহে। … যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। …যেখানে ধর্মের বন্ধন শিথিল, সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন।’ (অনুচ্ছেদগুলো মতিচুরের প্রথম খণ্ডে গ্রন্থিত)

রোকেয়ার রচনাবলীতে তার ধর্মভাবমুক্ত এবং ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী রূপ বেশি লক্ষ্য করা যায়। ধর্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যখনই কোন ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।’

‘কেহ বলিতে পারেন যে, ‘তুমি সামাজিক কথা কহিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন?’ তদুত্তরে বলিতে হইবে যে, ‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমনীর উপর প্রভূত্ব করিতেছেন। তাই ‘ধর্ম’ লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম।’ (রোকেয়া, কাদির, ১৯৭৩, পৃ. ১১-১৩)

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির বিষয়টি রোকেয়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তিনি মনে করেন সমাজের মুরব্বিদের আরোপিত ধর্মের নামই হলো অধর্ম। এতে ধর্মের ক্ষতিই দেখেন তিনি। অতিরঞ্জনের জন্য তিনি মুরব্বিদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমাদের কাঠমোল্লা মুরব্বিগণ শরীয়তের গলা টিপিয়া মারিয়া ইসলাম ও শরীয়ত রক্ষা করিতেছেন।’ এমনকি ধর্মের নামে পর্দাপ্রথার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সভ্যতার সাথে অবরোধ প্রথার বিরোধ নাই। তবে সকল নিয়মের একটা সীমা আছে। এদেশে আমাদের অবরোধ প্রথাটা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে।’

ধর্মের নামে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রোকেয়া আজীবন সোচ্চার ছিলেন। বর্তমান সময়ের নারীবাদীদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে অনেকক্ষেত্রে মিলে যায়। এমনকি আজকের তসলিমা নাসরিনের চেয়ে রোকেয়া সেইসময় কয়েকযুগ এগিয়ে ছিলেন। নারীদের পর্দাপ্রথা এবং নারী শিক্ষা ধর্মীয় অনুশাসনে বেধে দিয়েছিল বলে রোকেয়ার এতো প্রতিবাদ ছিল। নারী মুক্তির জন্য, নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য বাস্তবমুখী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন যা ছিল ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অবাস্তব, অবান্তর, উদ্ভট ও অলীক ধারণাদি বাঙালি মুসলমানের মনকে যেভাবে চেপে রেখেছিল, তাতে তিনি এই সম্প্রদায়ের ধ্বংসের সম্ভাবনা দেখেছিলেন। সেই সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার যুক্তিবোধ, অনুসন্ধিৎসা ও জীবনানুরাগ দেখিয়ে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এক ধর্মের এক দেশ নিয়ে। তাঁর মতে, ‘যে দেশে এক ঈশ্বরকে লোকে বিভিন্ন নামে ডাকে; একই ঈশ্বরের উপাসনা বিবিধ প্রণালীতে হয়; একই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট লোকে বিভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা করে, তথাপি সকলে ইহাই মনে করে যে, আমরা সকলে একই গন্তব্যস্থানে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়াছি এবং এইরূপ পার্থক্যের মধ্যে একতা থাকে; যদি কোনো দেশের ঐ অবস্থা হইতো, (কিন্তু অদ্যপি এমন কোনো ভাগ্যবতী দেশের বিষয় জানা যায় নাই।)- আমার মতে সে দেশ নিশ্চয়ই ধর্মে প্রধান হইত।’ এক্ষেত্রে রোকেয়াকে সেকুলার বলা যায়। তিনি আরও বলেন, ‘সব ধর্মেই কিছু না কিছু দোষ আছে। যদি কোনো ধর্ম অবলম্বন করতে হয়, তাহলে ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকে দেখা উচিৎ, তাহা না করিয়া কোন নরাধমকে দেখিয়াই তাহাকে দৃষ্টান্ত বলিয়া ধারণা করা অন্যায়। তবেই আমরা একে অপরকে ভ্রাতার ন্যায় ভালোবাসিতে শিখিবো এবং বন্য অসভ্যদের মতো একে অপরকে ঘৃণার চক্ষে দেখিব না।’ (বেগম রোকেয়া রচনাবলি. ৯৭)

রোকেয়া ধর্মের বিপক্ষে লিখলেও কখনো কখনো নৈতিক চরিত্র উন্নয়নে ধর্মচর্চার কথা বলেছেন। একজন আদর্শিক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে যার যার ধর্মমতে সৎ থাকার চেষ্টা করতে বলেছেন। ধর্ম সম্পর্কে রোকেয়ার অভিমত হলো, ‘প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণসমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে ধর্ম। ধর্ম ব্যতিরেকে মানুষ অধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিংবা সভ্যতা লাভ করিতে পারেনা।’ (রোকেয়া রচনাবলী: ৮২) তারজন্য ধর্মের ইতিহাস এবং দর্শন জানতে বলেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘কোনো ধর্ম পরীক্ষা করিতে হইলে, আমাদিগকে চারটি বিষয় সম্মন্ধে চিন্তা করিতে হয়। সর্বপ্রথম সেই ধর্মের উৎপত্তির ইতিহাস, যাহার প্রভাব তাহাতে (সেই ধর্মে) লুক্কায়িত থাকে। দ্বিতীয়, তাহার প্রকাশ্য বা বাহ্যিক মত অথবা শাখা পল্লব, যাহার সহিত সাধারণে সম্পর্ক রাখে। চতুর্থত, ধর্মের গূঢ় রহস্য, যাহাতে সাধারণত মানবের আপন অহং বা অস্তিত্ব জ্ঞানের ভাণ্ডারের সহিত মিশিবার স্বাভাবিক ইচ্ছা প্রকাশ পায়’ (বেগম রোকেয়া রচনাবলি. ৮৩। রোকেয়া মূলত অন্ধবিশ্বাসে ধর্মচর্চার ঘোর বিরোধী ছিলেন।

ধর্মের বিষয়টি রোকেয়া পুরোপুরি অবজ্ঞা না করে ধর্মচর্চার ব্যাপারে ইতিবাচক দিকনির্দেশ দিয়েছেন। তবে তখনকার সময়ে কাঠমোল্লা দ্বারা ভয়াবহ ধর্মচর্চা যেভাবে হতো তারই প্রতিবাদ তিনি করেছেন। যারা রোকেয়ার লেখা পড়েছেন এবং তাঁর বিভিন্নজনের কাছে পাঠানো তাঁর ব্যক্তিগত পত্রাবলি পড়েছেন, তাদের সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই যে, রোকেয়া কখনোই ইসলাম-বিরোধী ছিলেন না। তিনি ইসলামী অনুশাসনের অপব্যাখ্যা ও পর্দার নামে বাড়াবাড়ির বিরোধিতা করেছেন কেবল। ব্যক্তিগত জীবনে বেগম রোকেয়া যথেষ্ট ধার্মিক ছিলেন। তিনি জীবনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। নিয়মিত কোরআন অধ্যয়ন করতেন। (বেগম রোকেয়ার জীবনী: শামছুন নাহার)

বেগম রোকেয়া ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় নারী সম্মেলনে বলেছিলেন, শিক্ষা লাভ করা সব নর-নারীর অবশ্যই কর্তব্য। ইসলামী শিক্ষার প্রসারের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তিনি অর্থ বুঝে কুরআন পাঠের প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি বলেছেন, ‘শৈশব হইতে আমাদিগকে কোরান মুখস্থ করানো হয়, কিন্তু শতকরা নিরানব্বই জন তাহার একবর্ণেরও অর্থ বলিতে পারে না। যাঁহারা অর্থ শিখিয়াছেন, তাঁহারাও শোচনীয়রুপে ভ্রান্ত। ইসলামের মর্ম তাঁহাদের কাছে এক বর্ণও ধরা পড়ে নাই, ইহার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হইতে পারে? … নারিকেলের চমৎকার স্বাদ তাহার দুর্ভেদ্য আবরণের ভিতরে আবদ্ধ। অন্ধ মানুষ সেই কঠিন আবরণ ভেদ করিবার চেষ্টা না করিয়া সারাজীবন শুধু ত্বকের উপরিভাগটাই লেহন করিয়া মরিল’ (রোকেয়া জীবনী, শামছুন নাহার: ১২০)। এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। কোরান শিক্ষা অর্থে শুধু টিয়া পাখীর মত আরবী শব্দ আবৃত্তি করা আমার উদ্দেশ্য নহে। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় কোরানের অনুবাদ শিক্ষা দিতে হইবে। সম্ভবত এ-জন্য গভর্নমেন্ট বাধ্যতামূলক আইন পাশ না করিলে আমাদের সমাজ মেয়েদের কোরান শিক্ষাও দিবে না। যদি কেহ ডাক্তার ডাকিয়া ব্যবস্থাপত্র লয়, কিন্তু তাহাতে লিখিত ঔষধ-পথ্য ব্যবহার না করিয়া সে ব্যবস্থাপত্রখানাকে মাদুলী রূপে গলায় পরিয়া থাকে, আর দৈনিক তিনবার করিয়া পাঠ করে, তাহাতে কি সে উপকার পায়! লিখিত ব্যবস্থা অনুযায়ী কোন কার্য করি না, শুধু তাহা পাখীর মত পাঠ করি’ আর কাপড়ের থলিতে [জযুদানে] অতি যত্নে উচ্চস্থানে রাখি।’ (বঙ্গীয় নারী) একজন মুসলিম নারী হিসেবে রোকেয়া এভাবে আহবান করেছেন। তবে তিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকেও তাদের নিজ নিজ ধর্মচর্চা করতে একই কথা বলেছেন।

নারী জাগরণের জন্য ধর্ম একটি বড় অন্তরায় হলেও, রোকেয়া মনে করতেন নারী স্বাধীনতা, নারী শিক্ষা এবং নারী স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ধর্ম কোনো বাধা হতে পারে না। যার যার ধর্ম সে সে পালন করেও নারী হতে পারে স্বাবলম্বী, শিক্ষিত এবং ব্যক্তিত্ববান। তিনি বলেছেন, ‘আমি ভগিনীদিগের কল্যান কামনা করি, তাঁহাদের ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রিস্টানকে খ্রিস্টানী ছাড়িতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই'(মতিচূর (প্রথম খণ্ড)।

রোকেয়া আরও মনে করেন ধর্মটা একান্ত নিজের আত্মস্থের বিষয়। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করা হয় তা শুধুমাত্র নারীকে অবদমিত করে রাখার জন্য, সেখানেই রোকেয়ার প্রতিবাদ। তাছাড়া,বাস্তবতা এমন যে ধর্মকে উপেক্ষা করে সামাজিকভাবে সুস্থ স্বাভাবিক কাজ করাও সম্ভব নয়। তাই রোকেয়াকে কিছুটা পর্দা মেনে ও ধর্মচর্চা করে নারীমুক্তির কাজ করতে হয়েছিল। সেইদিক থেকে ভাবতে গেলে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট সেই একই অবস্থায় আছে। এমতাবস্থায় রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা এখনো অনস্বীকার্য।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর