হাওর বার্তা ডেস্কঃ ফুটেছে সূর্যমুখী হাওরের সবুজ বুক চিঁড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ফুল্লহাসি দিগন্তজুড়ে, পুষ্প-প্রকৃতিপ্রেমীর ঢল পড়ছে আছড়ে সুন্দরী রমণীর রূপসজ্জা নির্বিশেষে ঝরে।’ এ নবপ্রাণ হাওরের প্রকৃতিতে ও মনে। যেন মাটি ফুঁড়ে উঠেছে নবীন সূর্য সম্ভাবনার প্রত্যয়ে। হাওরের সবুজ জমিনে এই প্রথমবার জেগেছে প্রকৃতির অকৃত্রিম বন্ধু অসাধারণ এক রূপবান উদ্ভিদ সূর্যমুখী। যে ফুল পাগলপাড়া করে দিয়েছে তার রূপবৈচিত্র্য দিয়ে। ইতিমধ্যে প্রযুক্তির কল্যাণে রূপসী বাংলায় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশ-দুনিয়ায় ব্যাপক পরিচিত পাওয়া নৈসর্গিক হাওরে বিস্তীর্ণ উর্বর মাঠজুড়ে হাসছে প্রকৃতির সন্তান সূর্যমুখী। শিশু মন নেচে উঠছে সেই হাসির দোলায়, যা সবুজের বুকে হলুদমাখা ফুলগুলো ডাকছে অপরূপ সৌন্দর্যের স্বপ্নিল অঙ্গনার হাতছানিতে।
বাসন্তীরূপের স্নিগ্ধতার উৎসের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুষ্প-প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থী ও পর্যটকদের ঢল নেমেছে হাওর জনপদে। তাছাড়া বসন্ত উৎসব এবং ভালোবাসা দিবসের মিতালীতে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী ও নবদম্পতিদের প্রেম উৎসারিত ভালোবাসা দিবসের বাইরেও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তথা মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রেই ভালোবাসার এক অপার আবহে ভিড় হাওরজুড়ে। কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার সংযোগস্থাপনকারী অলওয়েদার রোডের জিরো পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্ব পাশ সংলগ্ন জমিনে কৃষক বাহাউদ্দিন ও কৃষাণী হাজেরা বেগমসহ আরও অনেকের সূর্যমুখী ফুলের চাষ দেখে মাতোয়া ভ্রমণপিপাসুরা প্রকাশ করছেন রোমাঞ্চকর যতসব অনুভূতি। তরুণী অনামিকা ও শ্রাবণী বলেন, ‘আহ্, কত্ত সুন্দর! একটি জমিতে ফুটেছে সূর্যমুখী, যেন পুরো মাঠ হাসছে প্রাণ খিলখিলে।
বিস্মিত হয়, যখন দেখলাম সূর্যমুখী ফুলই ঘাড় ঘুরাচ্ছে সূর্যতালে। থাকে সূর্যের দিকেই মুখ করে! এর জন্যই বুঝিবা নাম তার সূর্যমুখী।’ সুন্দরের মায়াময় প্রকৃতি দেখতে আসা দর্শনার্থী ললনা শাহীনূর নাহার, দোলনা ও উচ্চশিক্ষার্থী মানসুরা আক্তার প্রফুল্লচিত্তে বলেন, ‘সূর্যমুখী ক্ষেত দেখে মন ভরে উঠেছে এবং চাষে যেন প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছে নতুন করে কেউ। রূপ ফুলটির গতরে। হাসি যেন আনন্দের সম্ভার এবং চোরা গন্ধ বাতাসে দোল খেয়ে যখন নাকের ভেতর ঢোকে, কী মাদকতায় না হৃদয়জুড়ে জাগিয়ে তোলে মনভোলানো অনুভব।’ আবার অনেকের মোবাইলে বাজছে বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান– ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে সই গো বসন্ত বাতাসে।
হাওরের প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য বড়ই বৈচিত্র্যময়। সৌন্দর্যের দিক থেকে হাওরে বর্ষা মৌসুমে অথৈ জলের রূপ অন্যদিকে চলমান শুষ্ক মৌসুমে বোরো-রবি-খরিপ ফসলের রূপ। ফসল বৈচিত্র্য সৃষ্টির পেছনে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। সূর্যমুখী আবাদকারী বাহাউদ্দিন ও হাজেরা বেগম দৃষ্টিনন্দন কুসুম মেলায় ঝাঁপি খুলে বসেছেন ‘দর্শনার্থীদের মন্তব্য বহি’ নিয়ে। এখানে যে-যার মতো আবেগ প্রকাশ করে যাচ্ছেন– ‘মনের গহীনে ও চোখের পাতায় সমস্ত ভালো লাগা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি শহরে।’ শীতের বিবর্ণ সময়কে পাশ কাটিয়ে বসন্ত সূচনা করে নতুন প্রাণের। এবার শীতের শেষ দিক থেকেই প্রকৃতি ধীরে ধীরে রঙিন হতে থাকে বর্ণিল সাজে।সে রঙে রয়েছে হলুদের প্রধান্য। সরষে ফুলের মতো সূর্যমুখী ফুলও হলুদ।
পরিপক্ক ফল এবং ফসলের মাঠের রং হলুদাভ। ফলে উষ্ণ বসন্তে মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে হলুদ রঙের প্রভাব। প্রকৃতির এ প্রভাব থেকেই বসন্তের রং বাসন্তী। উষ্ণ সময়ের রং বলেই এটি আশা আর সুখের প্রতীক এবং পুরো পৃথিবীজুড়েই বিবেচিত শান্তি, সতেজ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সাহস ও গৌরবেরও প্রতীক হিসেবে। আবার ইতিবাচক ভাবনার প্রতীক হিসেবে মানুষ বহু আগেই বসন্তের রং হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাসন্তী রংকে। অর্থাৎ হালকা হলদি রংকে। সূর্যমুখী দেখতে রূপময়ই নয়, রূপ ও গুণেও অনন্য। এ সম্পর্কে গাজীপুরের জয়দেবপুর কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড: মোবারক আলীর সাথে আলাপচারীতায় মেলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট মানের ভোজ্যতেল সূর্যমুখী, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য অসাধারণ উপকারী।
এতে আছে শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড। ওমেগা ৬ ও ওমগা ৩ ফ্যাটি এসিড (লিনোলিক ও লিনোলেনিক এসিড) ও টেকোফেরল (ভিটামিন ‘ই’) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত। তেল শতভাগ উপকারী অসম্পৃক্ত ফ্যাটযুক্ত। নেই ক্ষতিকারক ইউরিক এসিড। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখী তেল নিরাপদ ও খু্বই উপকারী। একইভাবে সূর্যমুখীর ক্ষুদ্র বীজেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান। এতে মজুত আছে ২০% প্রোটিন, ৩৫.৪২% তেল এবং ৩১% অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। এছাড়া ভিটামিন হিসেবে রয়েছে এ, বি ৩, বি ৫, বি ৬, ই, ফোলেট।
তামা, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, দস্তা, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়ামের মতো খনিজ উপাদান, ডায়েটি ফাইবার এবং প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড। এগুলোতে ফ্লেভোনয়েডস এবং ফলিক এসিডের মতো প্রচুর উদ্ভিদ যৌগ রয়েছে। এসব হজম সহায়তা, ত্বক জীবাণুমুক্ত ও এন্টি এজিং হিসেবে কাজ করে, চুলের সৌন্দর্য বাড়ায় ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে, রক্তে শর্করার পরিমাণ ও ওজন কমায়। এছাড়া বীজ ছাড়ানোর পর মাথাগুলো এবং সূর্যমুখী খৈল গরু ও মহিষের উৎকৃষ্টমানের খাদ্য হিসেবে এবং গাছ ও পুষ্পস্তবকও ব্যবহৃত হয় জ্বালানি হিসেবে।
তেলসংক্রান্ত জটিল সব অসুখের হাত থেকে রক্ষা পেতে খাবারে তেলের ব্যবহার বাদ দিতে হয় যদিও, কিন্তু শরীরের জন্য দরকারও রয়েছে তেলের। সূর্যমুখী হতে পারে স্বাস্থ্য রক্ষায় গুণসম্পন্ন তৈলবীজ। এ তেল নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মতই নয়, আশীর্বাদস্বরূপও। দেশে বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী তেল উৎপাদন ও যথাযথভাবে আহরণ করা গেলে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা বহুলাংশে কমে যাবে। এতে একদিকে যেমন বিদেশ থেকে তেল আমদানি কমে যাবে অন্যদিকে তেমনি বাড়বে তেলের দেশজ উৎপাদনও।