দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে আমদানি করা সয়াবিন তেলের ওপর নির্ভরশীল। এই তেলে রয়েছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক অনেক উপাদান, যা ছিল না স্থানীয়ভাবে ভাঙানো সরিষার তেলেও। সরিষার তেলই ছিল বাঙালির তেলের চাহিদা পূরণের প্রধান তৈলবীজ। আরও ছিল তিল, তিসি, বাদাম। এই তিনটি তৈলবীজের তেলেও ক্ষতিকারক উপাদান নেই এতটা, যতটা আছে আমদানি করা সয়াবিন তেলে। নিরাপদ ভোজ্যতেলের চাহিদা থেকে বাণিজ্যিকভাবে এবারই প্রথম শুরু হয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরে বোরো ফসলের পাশাপাশি সূর্যমুখী ফসলের চাষ। যা রবি চাষে পুনর্বাসনের আওতায় ইটনায় ২৭ হেক্টর, মিঠামইন ২৭ হেক্টর, অষ্টগ্রাম ২০ হেক্টর ও নিকলী উপজেলায় ২০ হেক্টর জমিতে ৭শ জন কৃষক-কৃষাণী হাইব্রিড সূর্যমুখীর আবাদ করেছে।
চাষের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৯৪ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৯০ টন এবং তেল প্রায় ৮৫ টন। ইটনার বড়িবাড়ি ব্লকের শিমুলবাগের কৃষক আ: হেকিম, পূর্বগ্রাম ব্লকের মির্দাহাটির শহিদুল ইসলাম ও কৃষাণী মোমেনা বেগম, মিঠামইনের মহিষারকান্দি ব্লকের বেড়িবাঁধের কৃষক বাহাউদ্দিন, ইসলামপুর ব্লকের মুজিবুর রহমান ও কৃৃষাণী জোসনা আক্তার, গোপদিঘী ব্লকের খাসাপুর গ্রামের আ: রহমান ও কৃষাণী আয়শা খাতুন, অষ্টগ্রামের আদমপুর ব্লকের নূরপুর গ্রামের আব্দুল্লাহ্ আল মামুন ও মো: নাঈম সূর্যমুখীর চাষ প্রথম করায় এর সুফল অজানা। তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগ ফসলটি লাভজনক এবং ফুল থেকে তেল তোলা যায় ৯০-১০০ দিনের মধ্যে, যার বাজার মূল্য বেশি এবং খরচও অপেক্ষাকৃত কম বলায় উৎসাহিত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তাঁরা।
সূর্যমুখী চাষের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে নিকলী উপজেলার ষাইতদার গ্রামের কৃষক জালাল, উদ্দিন, কৃষাণী হোসনেহার ও মিয়া হোসেনের। তাঁদের ভাষায় শোনান আলাদীনের চেরাগের নয়, সত্যকাহনের গল্প। মাত্র ৪০ শতক জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করে খরচ বাদে প্রায় চারগুণ বেশি লাভ পেয়েছিলেন বলে বিজয়ের গালভরা হাসিতে রহস্যভরে বলেন, বীজ অইছিন ৮ মণ আর ঘানির মালিকরে খৈল দিয়ে তেল অইছিন ৬০ কেজির ওফরে। ৫শ ট্যাহা কেজিতে মাইনষে বাড়িত থেইক্যা কিন্না নিছেগা।
ট্যাহা পাইছি ৩০ হাজার। তাছাড়া সারাবছর তেলও খাইছি ফাও। অথচ খরছ অইছিন ৮ হাজারের মতো। সূর্যমুখী ফসলের ব্যাপক চাষে হাওরের কৃষকের দুর্দিন ঘুচে যেতে পারে বলে বিপুল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অভিমত ব্যক্ত করেন তাঁরা। অধিক লাভজনক হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় ও পরামর্শে এবারও নিকলীর কৃষক জালাল উদ্দিন ও কৃষাণী হোসনেহার একাই সূর্যমুখী চাষ করেছেন একশ শতক জমিতে। এতে ২২-২৩ হাজার টাকা খরচ করে এক লাখ ২০ হাজার টাকা গাঁটে তোলার বাসনা থাকলেও দর্শনার্থীরা বারো আনা পুষ্পস্তবক বিনষ্ট করে ফেলায় সব আশা-ভরসা ভেস্তে যাবার হতাশা ব্যক্ত করেন তাঁরা।
এমন আপদের অনুযোগ প্রায় সর্বত্রই। এর জন্যই মিঠামইন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আলীনূর আলম ‘কৌতূহলের বশে কৃষকের ফসল নষ্ট না করার অনুরোধ’ জানান দর্শনার্থীর মন্তব্য বইতে। কৃষি উদ্যোগের যুগে পা রাখা হাওর উপজেলা মিঠামইনে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পরিদর্শন করে এসেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক বশির আহম্মদ সরকার, ঢাকা খামারবাড়ির অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) মো: মিজানুর রহমান, কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছাইফুল আলম ও অতিরিক্ত উপপরিচালক আশেক পারভেজ।
তারা বলেন, হাওরাঞ্চলের আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি তথা পরিবেশ অনুকূলে থাকায় নতুন সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে সূর্যমুখীর চাষ ও তেল উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনাময় এই হাওরাঞ্চল। ভুট্টার ক্ষেত্রেও। হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার প্রায় ৪৭ টি উপজেলার কৃষক বোরো ফসলে দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ খাদ্য জোগানদাতা। কৃষির সর্বব্যাপী ভূমিকায় তা নিরাপদ ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রেও উর্বরক্ষেত্র। বহুযুগের সংকট উৎপাদকের জন্য একটি মূল্য কমিশন গঠনের সংকীর্ণতাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতায় প্রকৃত প্রান্তিক কৃষক কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় হাওরে কৃষির পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে যাচ্ছে।
বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থেকে যাওয়ায় প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদন সম্ভব হয় না, যা কৃষকদের জন্য এক বড় হতাশা। দুর্ভোগের কান্নাও। সবুজ ঘাসে ছেয়ে যাওয়া ফসলি মাঠ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গরিবের নিউজিল্যান্ড’ খ্যাতি পেয়ে কৃষকের আর্তনাদ হয়ে উঠেছে বিনোদনের অনুষঙ্গ। কৃষি উদ্যোগের এ যুগে বিশেষ ভর্তুকিতে সমগ্র হাওরাঞ্চলের এসব জমি কৃষি বিভাগের পরামর্শে সূর্যমুখী, ভুট্টা ও সবজি চাষের আওতায় আনা হলে মুজিববর্ষে কৃষিতে বদলাবে বাংলাদেশ, কৃষিতে বদলে যাবে হাওরাঞ্চল।
রফিকুল ইসলাম: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।