যে কারণে ৪০ বারের বেশি বন্ধ ছিল হজ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইসলামের ইতিহাসে বিগত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে হজ স্থগিত কিংবা স্বল্প পরিসরে আয়োজনের ঘটনা ঘটেছে ৪০ বারের মতো। প্রতি বছরই কোনো কোনো কারণে তা স্থগিত কিংবা অল্প আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

হারামইন কর্তৃপক্ষের গবেষণা ও আর্কাইভে বাদশাহ আব্দুল আজিজ ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে ইতিহাসে প্রায় ৪০ বার হজ বাতিল করা হয়েছিল কিংবা হজযাত্রীর সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। যা ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন।

 হজ বন্ধ থাকা বা স্থগিত হওয়ার কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-
– মহামারী / রোগ (Epidemics/Diseases)
– রাজনৈতিক অশান্তি (Political turmoil)
– অর্থনৈতিক অশান্তি (Economic turmoil)
– নিরাপত্তা অস্থিরতা (Instability of security)
– দ্বন্দ্ব (Conflicts)
– ডাকাত কিংবা হানাদারদের আক্রমণ কার্যক্রম। (Activities of bandits and raiders)

যে কারণে ৪০ বারের বেশি বন্ধ ছিল হজ। কিছু বছর হজ বন্ধ ছিল আবার কিছু বছর হজ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য ঘটনাগুলো প্রকাশ করেছেন হারামাইন কর্তৃপক্ষ। আর তাহলো-

– ২৫১ হিজরি মোতাবেক ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ
ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে এ বছর হজ বাতিল হয়। আব্বাসিয় খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অংশ হিসেবে ইসমাইল বিন ইউসুফ আল-আলাউই সাফাক নামে পরিচিত গোষ্ঠী সে বছর পবিত্র নগরী মক্কার ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়। হজে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য হাজিকে তারা হত্যা করে। ফলে সে বছর হজ স্থগিত করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

– ৩২৭ হিজরি মোতাবেক ৯৩০ খ্রিস্টাব্দ
হজের ইতিহাসে এ বছর সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটেছিল। ঐতিহাসিক হিসাব অনুযায়ী সে বছর ৩০ হাজারের বেশি হজপালনকারীর উপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল। জমজম কুপকে চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার মানসে প্রায় ৩ হাজার হাজির মৃতদেহ এ কুপে ফেলা হয়েছিল। ওই বছর পবিত্র কাবা ঘরে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ ভেঙে লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। যা দীর্ঘ ২২ বছর নিখোঁজ ছিল। তারপর থেকে দীর্ঘ ১০ বছর হজ অনুষ্ঠিত হয়নি।

আল-মাশিরি নামক অজানা রোগের কারণে সে বছর হজর বাতিল হয়। অনেকে হজ পালন করতে রওয়ানা হয়ে পথেই মারা যান। হজযাত্রীদের বহনকারী উটগুলোও পথেই মারা যায়। সে বছর হজের উদ্দেশ্যে যারা যাত্রা শুরু করেছিল তাদের অল্প কয়েকজন ছাড়া কেউই পবিত্র নগরী মক্কায় আসতে পারেনি।

– ৩৯০ হিজরি মোতাবেক ১০০০ খ্রিাস্টাব্দ এবং ৪১৯ হিজরি মোতাবেক ১০২৮
৩৯০ হিজরি মোতাবেক ১০০০ খ্রিস্টাব্দ এবং ৪১৯ হিজরি মোতাবেক ১০২৮ খ্রিস্টাব্দে হজ স্থগিত ছিল। বিশ্বব্যাপী চরম মূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি তথা ভয়াবহ অভাবের কারণে কেউই সে বছর হজ করতে পবিত্র নগরী মক্কায় আসেনি। এমনকি চরম অভাবের কারণে এ বছরগুলোতে পূর্ব অঞ্চল ও মিসর থেকেও কেউ হজে আসেনি।

– ৪৯২ হিজরি মোতাবেক ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ
চরম অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে এ বছর হজ অনুষ্ঠিত হয়নি। সে সময় বড় বড় রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নিয়োজিত ছিল। ফলে নিরাপত্তা ও অশান্তির কারণে কেউ হজে অংশগ্রহণের সাহস করেনি। ফলে এ বছর হজ অনুষ্ঠিত হয়নি। ক্রুসেডারদের হাতে জেরুজালেম দখল ও পতনের পাঁচ বছর আগের ঘটনা এটি।

– ৬৪৫ হিজরি মোতাবেক ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ
এ বছর থেকে মোট ৪ বছর অনুষ্ঠিত হয়নি। শুধু হিজাজের লোকজন হজে অংশগ্রহণ করেছে। সে সময় চলমান আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে কেউ হজে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

– ১২১৩ হিজরি মোতাবেক ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ
সে সময় ফরাসি বিপ্লব চলছিল। হজযাত্রীদের চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং রাস্তা অনিরাপদ হওয়ায় সে বছর হজযাত্রীরা হজে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

– ১২৪৬ হিজরি মোতাবেক ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ
সে সময়ের তথ্য মতে, ভারত থেকে আসা একটি মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। হজের সময়ে ছড়িয়ে পড়া এ মহামারিতে হজে অংশগ্রহণকারী (বেশির ভাগ) তিন চতুর্থাংশ মানুষ মারা যায়। ফলে সে বছরও হজ অনুষ্ঠিত হয়নি।

– ১২৫২ হিজরি মোতাবেক ১৮৩৭ এবং ১৩১০ হিজরি মোতাবেক ১৮৯২ খিস্ট্রাব্দ
এ সময়ের মধ্যে বেশ কয়েক বছর মহামারির কারণে হজ অনুষ্ঠিত হয়নি। এ দীর্ঘ ৫৫ বছর সময়ের মধ্যে মহামারির কারণে বেশ কয়েক বছর হজ করতে পারেনি হজ যাত্রীরা। হজের মৌসুমে কলেরা নামক মহামারির প্রাদুর্ভাবে অনেক মানুষ মারা যাওয়ার ভয়ে অনেকেই হজে অংশগ্রহণ করেনি। সে সময় এ কলেরায় অনেকে আরাফাতে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকে মিনায় ধরাশায়ী হয়ে যান।

– ১৪৪১ হিজরি মোতাবেক ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
কোভিড-১৯ নামক নভেল করোনাভাইরাসের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে হজ পালনকে স্থগিত করা হয়েছে। সীমিত আয়োজনে স্বল পরিসরে স্থানীয় ও দেশটিতে থাকা বিদেশিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে হজ।

শতাব্দীর ভয়াবহ অজানা আতংক প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি কোভিড ১৯ নভেল করোনাভাইরাসের পুরো বিশ্ব আক্রান্ত। ২০১৯ সালের শেষ দিকে এ ভাইরাসটি চীনের উহানে দেখা দেয়। মাত্র অল্প কয়েম মাসের মধ্যে বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাস ব্যাপক আকার ধারণ করে। যার ফলে ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে পবিত্র নগরী মক্কা-মদিনার খাদেম রাষ্ট্র সৌদি আরব মক্কায় ওমরা ও মদিনায় জেয়ারত নিষিদ্ধ করে দেয়। দীর্ঘ ৩ মাস নিষেধাজ্ঞা, কারফিউ থাকার পর তা দুই ধাপে শর্তসাপেক্ষে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে খুলে দেয়া হয়েছে।

হজ নিয়েও ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব। অবশেষ একেবারেই স্বল্প পরিসরে সীমিত আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে হজ। তবে তা না হওয়ারই মতো। কারণ সৌদি আরবের বাইরের কোনো দেশ থেকে এবারের হজের মৌসুমে কেউ আসবে না। সৌদির স্থানীয় ও সৌদিতে অবস্থানকারী বাইরের দেশের কিছু লোকের অংশগ্রহণে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধান, পরিচালনা ও দি-নির্দেশনায় পরিচালিত হবে হজ। তবে হাজিদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ হাজারের বেশি হবে না। এমনই ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির হজ মন্ত্রণালয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর