Exif_JPEG_420

শিশুবান্ধব সমাজ গঠনের স্বপ্ন। অধ্যক্ষ আসাদুল হক

সম্প্রতি সারা দেশে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপিত হলো শিশু অধিকার সপ্তাহ। ‘সিআরসি’ নামে পরিচিত জাতিসংঘঘোষিত চাইল্ড রাইট কনভেনশনে অন্যতম স্বাক্ষরদাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বরাবরই শিশু অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে সোচ্চার। প্রকৃতপক্ষে একটি সমাজ শিশুদের জন্য কতটা নিরাপদ, রাষ্ট্র তাদের চাহিদা পূরণে এবং অধিকার রক্ষায় কতটা আন্তরিক এবং অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে সেই সমাজের প্রাগ্রসর মানুষ শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কতটা তৎপর- এসব মানদণ্ডে বিচার করে সেই রাষ্ট্র বা সমাজ কতটা উন্নত, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘দেশে একটি শিশুও রাস্তায় থাকবে না।’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ‘শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘গৃহকর্মী নির্যাতন এবং কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু নিয়োগ সরকার কোনোভাবেই মেনে নেবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার কোনো ধরনের শিশু নিপীড়ন বরদাশত করবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য যথার্থই সমাজে শিশুদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা বোধ করি শিশুবান্ধব একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। শিশু অধিকার সপ্তাহে শুধু একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনার শিরোনামে আমাদের সমাজ-বাস্তবতার কিছু চিত্র পাওয়া যেতে পারে।

‘ঝালকাঠিতে পিটিয়ে শিশুর হাত ভেঙে দিল পুলিশ’, ‘প্রেম প্রত্যাখ্যান : স্কুল গেটে ছাত্রী খুন’, ‘কালিহাতীতে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার’, ‘গাজীপুরের জঙ্গলে বাঁশের সঙ্গে বাঁধা স্কুল ছাত্রীর লাশ’, ‘সালথায় বাবা খুন- সন্তানদের অপহরণের হুমকি, ভয়ে স্কুলে যাচ্ছে না দুই মেয়ে’, ‘কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা’, ‘দুধ খাওয়ায় খুন্তির ছেঁকা’, ‘এবার কিশোরগঞ্জে স্কুল গেটে ছাত্রীকে কোপাল বখাটে’। এই শিরোনামগুলোর বাইরেও ঘরে আটকে রেখে গৃহকর্মী নির্যাতন, শিশু ধর্ষণের অভিযুক্তদের সঙ্গে পুলিশের গোপন বৈঠক, শিশু বিয়ে এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশু-কিশোরদের নিয়ে সংবাদ এবং প্রতিবেদন ছড়িয়ে আছে পত্রিকার পাতায়। আর সারা দেশে ঘটে যাওয়া এ ধরনের আরো অসংখ্য ঘটনা, যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি, তার পরিসংখ্যান অজানা হলেও নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রকাশিত ঘটনার চেয়ে তা অনেক অনেক গুণ বেশি।

পত্রিকার শিরোনামগুলো থেকে অনুমান করা যায়, শিশুদের শারীরিকভাবে নির্যাতনের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন অনেক সময়ই শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্কুলে শিক্ষকদেরও যখন শারীরিক নির্যাতন থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তখন শিশুরা পরিবারে, প্রতিবেশীদের দ্বারা, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিতদের হাতে এবং শ্রমিক শিশুরা কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হচ্ছে। অন্যদিকে শিশুর অধিকার রক্ষায় আইন প্রয়োগের দিক থেকে যাদের সবচেয়ে তৎপর থাকার কথা, সেই পুলিশই কখনো নির্যাতনকারী, কখনো ধর্ষক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিপীড়কের নয়, নিপীড়নকারীর সহায়ক শক্তি হিসেবে উপস্থিত। বখাটেদের সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে না পারা এবং পুলিশের উদাসীনতার কারণে আবারও বেড়েছে স্কুল ছাত্রী ও কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করার হার। এক সপ্তাহে স্কুল গেটে হত্যা ও ছুরিকাঘাতের একাধিক ঘটনা সেই অশুভ সত্যেরই ইঙ্গিত দেয়।

আমাদের দেশে পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, শিশুদের স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হয়েছে নতুন সুযোগ-সুবিধা, বেড়েছে শিশুশিক্ষার হার। কিন্তু এসব ইতিবাচক অর্জনের পাশাপাশি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে শিশুর প্রতি সহিংসতা। শিশু নির্যাতন ও শিশুর প্রতি ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক আচরণ সমাজের অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটায়। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন অকারণে কিংবা সামান্য কারণে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে একজন শিশুকে গুলি ছুড়ে আহত করেন, তখন তা সামাজিক অস্থিরতার সঙ্গে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার দম্ভ ও সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞার স্বরূপ তুলে ধরে। অন্যদিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সাধারণ মানুষের প্রীতি-ভালোবাসায় অভিষিক্ত মানুষও যখন তার গৃহকর্মী শিশুটির প্রতি মানবিক আচরণ দেখাতে ব্যর্থ হয়, তখন প্রশ্ন জাগে- শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিজগতের যেসব মানুষ তাদের কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে, তাদের এই মানবিক দীনতার কারণ কী?

একজন স্বনামধন্য ক্রীড়াবিদ কিংবা জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক নেতারই যখন সামান্য উত্তেজনায় বুদ্ধিবিলোপ ঘটে, তখন শিশুর ‘অপরাধের শাস্তি’ হিসেবে একজন ওয়ার্কশপ মালিক, প্রবাসী শ্রমিক, গ্রামের চৌকিদার, মোটরসাইকেল মেকানিক অথবা সাধারণ কোনো গৃহবধূর কাছ থেকে মানবিক আচরণ আশা করাটা কতটা যৌক্তিক হবে? শিশুটি যদি অসহায় দরিদ্র কারো সন্তান হয়ে থাকে, তাহলে তার অসহায়ত্ব নির্যাতনকারীকে উৎসাহিত করে, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার কোনো ধার ধারেন না নিপীড়ক ক্ষমতাবান মানুষটি। সে ক্ষেত্রে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়ার দায়িত্বটিও তিনি নিজের হাতেই তুলে নেন।

শিশু অধিকার সপ্তাহের নানা নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি কয়েকটি আশাব্যঞ্জক খবরও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকার পাতায়। এ সপ্তাহেই শিশু সৌরভকে গুলি করায় অভিযুক্ত সংসদ সদস্য লিটন গ্রেপ্তার হয়েছেন, রাজন হত্যা মামলার প্রধান আসামি কামরুলকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে, গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত ক্রিকেটার শাহাদত হোসেন ও তাঁর স্ত্রীর জামিনের আবেদন আদালতে নাকচ হয়ে গেছে এবং খুলনায় শিশু রাকিব হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে। এরপর বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে অশ্রুপাত না করে যদি প্রকৃত অপরাধীর যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে শিশুবান্ধব সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যেতে পারব আরো এক ধাপ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর