সবজি চাষ বিধ্বস্ত সড়কের কারণে মিলছে না ন্যায্য দাম

একের পর এক বন্যার সঙ্গে লড়াই করে আগাম শীতের সবজি চাষ করেছেন কৃষক। ক্ষেতে ফলনও হয়েছে বেশ। কিন্তু বন্যায় বিধ্বস্ত সড়ক যোগাযোগের কারণে সবজির ন্যায্য মূল্য মিলছে না।

তিন মাসে চার দফা বন্যার কবলে পড়ে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার কৃষক নিঃস্ব। বঞ্চিত হয়েছেন সরকারি কৃষি প্রণোদনা থেকেও। কিন্তু বসে থাকেননি তাঁরা। পুঁজি হারানো কৃষক ধার-কর্জ করে বৃষ্টির মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে আগাম শীতের সবজি চাষ করেছেন। কিন্তু উৎপাদনের পর বন্যায় বিচ্ছিন্ন ও বিধ্বস্ত সড়ক যোগাযোগের কারণে সবজির সঠিক দাম পাচ্ছেন না।

চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের কৃষক রেজাউল করিম বলেন, ‘অন্য এলাকার তুলনায় আগে-ভাগে সবজি উৎপাদন হওয়ায় কাকারার সবজি গ্রামে চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর ব্যবসায়ী আসছেন। সাতসকালে ক্ষেত থেকে সরাসরি সবজি কিনছেন। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। আর বিধ্বস্ত যোগাযোগের কারণে কৃষক চকরিয়ার আড়তে গিয়েও সবজি বিক্রি করার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।’

ওই এলাকার কৃষক জানান, গত বছর চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের দক্ষিণ কাকারায় ব্যাপক সবজি আবাদ হয়। এই কারণে চট্টগ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী সেখানে গিয়ে সবজি কিনে বড়-ছোট ট্রাকে সরাসরি চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে নিয়ে যান। ওই সময় মিনিবাজার, পাহাড়তলী, মাঝেরফাঁড়ি বাজার এবং পার্শ্ববর্তী সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নে সবজির অস্থায়ী আড়ত বসেছিল। সেখান থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে সরাসরি ট্রাকে সবজি ভর্তি করতে ব্যবসায়ীরাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কিন্তু এবার তা সম্ভব হচ্ছে না। সামপ্রতিক কয়েক দফা বন্যায় এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

স্থানীয় কৃষক মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘গত বছর বেশির ভাগ কৃষক এলাকায় সবজি বিক্রি করেছেন। কেউ কেউ চকরিয়ার আড়তে নিয়ে গেলেও পরে লাভ-লোকসান হিসাব করে পুনরায় ক্ষেত থেকে সবজি বিক্রি করে লাভ গুনেছেন। সেই অভিজ্ঞতায় এবারও সবাই ক্ষেতে সবজি বিক্রি করছেন। কিন্তু প্রকৃত দাম মিলছে না।’

আধাকানি ক্ষেতে চিচিঙ্গা চাষ করেছেন মোহাম্মদ শফিউল্লাহ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘চকরিয়া উপজেলা সদরের সঙ্গে কাকারায় চলাচলের প্রধান সড়কটি বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এর ফলে প্রথমে রিকশায় বা ট্রাক্টরের মতো ট্রলিগাড়িতে বস্তাভর্তি সবজি চার কিলোমিটার দূরের চকরিয়ায় নিতে হচ্ছে। সেখান থেকে সবজিগুলো ট্রাকে চট্টগ্রাম নিতে হয়। এতে সবজি পরিবহনে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। আর বোঝাটা চাপছে আমাদের ওপর। সেজন্য প্রতিকেজি চিচিঙ্গা পাইকাররা ক্ষেত থেকে তিন থেকে চার টাকা কমে কিনছেন।’

শুধু চিচিঙা নয় ঢেঁড়স, বরবটি, খিরা ও ঝিঙাতে কেজিপ্রতি তিন থেকে ছয় টাকা কমে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। এ প্রসঙ্গে পাইকারি ব্যবসায়ী সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘সড়ক যোগাযোগ ঠিক থাকলে বেশি সবজি কিনতে পারতাম। কৃষকও দাম বেশি পেতেন।’

কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মেহেদি হাসান নূর খান বলেন, ‘এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সবজি পরিবহনে ভোগান্তির বিষয়টি ক্ষুব্ধ কৃষক আমাদের জানিয়েছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় এখনই সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না। উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান সড়ক ছাড়াও অভ্যন্তরীণ প্রায় সব সড়ক এখনো চলাচলের অনুপযোগী। সড়ক সংস্কারে উপজেলা পরিষদ থেকে জরুরিভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ দিলে এখানকার কৃষক প্রাণ ফিরে পাবেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একের পর এক চার দফা বন্যায় চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার কৃষক কৃষিখাতে কোনো সরকারি সহায়তা পাননি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সামপ্রতিক এসব বন্যার পর এই দুই উপজেলা সফর করেন। এ সময় তাঁর কাছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ত্রাণের বদলে ঋণ ও অবকাঠামো সহায়তার দাবি জানিয়েছিলেন। ওই দুটি দাবির একটিও পূরণ হয়নি। কিন্তু বসে থাকেননি তাঁরা। ধার-কর্জ করে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজ উদ্যোগে ফসল ফলিয়েছেন। তবু তাঁরা সবজির ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।

সড়কের কারণে সবজি পরিবহনে ব্যাঘাতের কথা স্বীকার করেছেন চকরিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৃষ্টি শেষ হয়েছে মাত্র গত সপ্তাহে। ফলে সড়ক যোগাযোগ উপযোগী করার অনুকূল পরিস্থিতি হয়নি। তাছাড়া এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি), টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি) এর বরাদ্দগুলো আমরা এখনো পাইনি। বন্যাদুর্গত এলাকা হিসেবে আমরা এসব বরাদ্দ সারাদেশের চেয়ে একটু আগে-ভাগে চাইলেও সরকারি অনুমোদন মিলেনি। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে না থাকলে কাজগুলো দ্রুত শুরু করা সম্ভব হত।’

ইউএনও আরো বলেন, ‘গত বছর এডিপি বরাদ্দ ছিল মাত্র ৪৮ লাখ। এবার চেয়েছি ১০ কোটি টাকা। আর এলজিইডি মন্ত্রণালয় থেকেও ১০ কোটি টাকা চেয়েছি। কিন্তু এ পর্যন্ত বরাদ্দ মিলেছে শুধু এমপির বরাদ্দ। সব বরাদ্দ একসঙ্গে সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করতে একটি পরিকল্পনা নিয়েছি। এ জন্য ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে আগামী একবছরে কী কাজ করবে তা জানাতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলাকার সুষম উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর