নতুন সাজে টাঙ্গাইল আ.লীগ

নতুন সাজে সাজানো হয়েছে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের পরিচালনা পরিষদ। দীর্ঘ ১১ বছর পর গতকাল রবিবার ত্রিবার্ষিকী সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়।

নতুন কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের হাল ধরার সুযোগ পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সাংসদ, জেলা পরিষদের প্রশাসক ফজলুর রহমান খান ফারুক এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের।

নতুন এ পরিচালনা পরিষদে বাদ পড়েছেন ক্ষমতাধর খান ও সিদ্দিকী পরিবারের সদস্য ও অনুসারীরা। ফলে এই দুই পরিবারের ক্ষমতার অনেকটাই ইতি টানা হয়েছে। পরিবারভিত্তিক রাজনীতির বেড়াজাল পেরিয়ে নতুন আঙ্গিকে দলকে ঢেলে সাজানোর বিষয়টি ইতিবাচক মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এতে জেলা উপজেলার নেতাকর্মীদের দলীয় কার্যক্রমের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

ত্রিবার্ষিক সম্মেলন নামকরণ হলেও গত এগারো বছর যাবত দলীয় কার্যক্রম ঢিলেঢালাভাবে চলছিল পুরোনো এই কমিটি দিয়ে। ২০০৪ সালের ৫ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর আর গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচন করার সুযোগ পায়নি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

৭১ সদস্যবিশিষ্ট সভাপতি শামসুর রহমান খান শাহজাহান, সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট বাদশাহ মিয়া, কৃষি সম্পাদক আবদুর রশিদ, উপ-দপ্তর সম্পাদক মনজুরুল হক তালুকদার, সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহান, শওকত আলী তালুকদারসহ এ কমিটির ১৩ জনই ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তারপরও চলছিল কমিটির কার্যক্রম। লতিফ সিদ্দিকীর ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য আর খান পরিবারের ওপর মামলা। এই সুযোগে পরিবর্তন এসেছে জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে। নেতাকর্মীরা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ছাউনি থেকে বেরিয়ে তৃতীয় নেতৃত্বের সন্ধান পেয়েছে।

“খান” ও “সিদ্দিকী” পরিবারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দু-পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে দীর্ঘদিন ঝিমিয়েছিল। ফলে গত এগারো বছরে নানা প্রতিকূলতা পরিবেশ সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে। দলের ভেতর সৃষ্টি হয় অন্তর্কোন্দল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে দলের নেতাকর্মীরা। দলের এ হযবরল অবস্থায় নতুন কমিটি গঠন হওয়ায় শহরের আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা যায় দলের নেতাকর্মীদেরকে।

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের পেছনে ফিরে দেখা যায়, আওয়ামীপন্থি নেতাকর্মীরা শুরু থেকে “সিদ্দিকী ” ও “খান” এই দু-পরিবারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পুরো নব্বয়ের দশক রাজত্ব করেছে সিদ্দিকী পরিবার। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ ছেড়ে বা বহিষ্কার হওয়ার পর নতুন দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে সিদ্দিকী পরিবারের ক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। কাদের সিদ্দিকীর সাথে সাথে আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসেন তার ছোট দুই ভাই মুরাদ সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকী। এই দুই ভাই কাদের সিদ্দিকীর শক্তি বলে পরিচিত। ফলে আওয়ামী লীগে একা হয়ে পড়েন বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী। আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসায় কাদের সিদ্দিকীসহ আজাদ ও মুরাদ অনেকটাই ক্ষমতার দিক দিয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। তারপরও ছোট ভাইয়েরা যতটুকু ক্ষমতা দেখাতেন সেটুক লতিফ সিদ্দিকীকে পুঁজি করেই। সম্প্রতি লতিফ সিদ্দিকী দল থেকে বহিষ্কারের পর টাঙ্গাইল শহরে তাঁর দুই ভাই মুরাদ সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকীর যেটুকু আধিপত্য ছিল, তাও শেষ হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় সিদ্দিকী পরিবারের আপাতত আওয়ামী রাজনীতিতে অবসান ঘটেছে।

এদিকে সিদ্দিকী পরিবারের ক্ষমতা বণ্টন অন্য দিকে খান পরিবারের বড় কর্তা বাপ্পির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। অল্প সময়েই খান পরিবার নজর কাড়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের। ফলে ক্ষমতা চলে আসে খান পরিবারের হাতে। সিদ্দিকী পরিবারের বিকল্প হিসেবে এই শক্তির উত্থানকে সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতাকর্মীরা স্বাগত জানিয়েছিলেন এই পরিবারটিকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই পরিবারের ওপর জনগণ হতাশ হয়েছে। পরিবারটি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগসহ সব অঙ্গসংগঠন ধীরে ধীরে দখলে নেয়ার পরও সাধারণ নেতাকর্মীদের আস্থাভাজন থাকতে পারেনি। যে কারণে সাধারণ মানুষসহ খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাংসদ আমানুর রহমান খান (রানা), টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র সহিদুর রহমান খান (মুক্তি), ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান (কাকন) ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সানিয়াত খান (বাপ্পা) এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় টাঙ্গাইল মডেল থানাসহ বিভিন্ন থানায় প্রায় অর্ধশত মামলা হয়।

তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার ঘটনায় এই চার ভাইয়ের নাম আসায় নতুন করে চাপে পড়ে পরিবারটি। এই নতুন অভিযোগে তারাও গত এক বছর ধরেই গা ডাকা দিয়েছে। বিভিন্ন সময় জেলা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এই দুই পরিবার যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়ে। প্রায়ই দেখা গেছে খান পরিবারের সমর্থকরা সিদ্দিকী পরিবারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মিছিল সমাবেশ করছে। আবার মামলার ইস্যু নিয়ে খান পরিবারের বিরুদ্ধে মিছিল সমাবেশ করতে দেখা যায় সিদ্দিকী পরিবার অনুসারীদের। ফলে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগই।

উভয় পরিবার বেকায়দায় পড়ায় এই দুই পরিবারের বাইরে থাকা কোণঠাসা নেতাকর্মীরা আবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেন। তারা তৃতীয় একটি গ্রুপ মনে করে আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ খুন হওয়ার পর তার স্ত্রী নাহার আহমদের নেতৃত্বে চলে আসেন। এসব কারণে নেতাকর্মীরা তিন ভাগে বিভক্ত থাকায় দলীয় কার্যক্রময় অনেকটাই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হতো।

জেলা উপজেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে এরকম একটি কমিটি দেয়ায় ঐক্যবদ্ধভাকে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে একটি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য কমিটি তৈরির সম্মেলনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সংসদ সদস্য খন্দকার আসাদুজ্জামান, খন্দকার আব্দুল বাতেন এমপি, একাব্বর হোসেন এমপি, ছানোয়ার হোসেন এমপি উপস্থিত ছিলেন।

এসময় টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের অতীত ও বর্তমান অবস্থা আঁচ পেয়েই আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ নিহত প্রসঙ্গে মতিয়া চৌধুরী বলেন, ফারুক ভাই আজ নেই কেন? জেলা আওয়ামী লীগকে এই আত্মঘাতী খেলা বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে নতুন এই কমিটি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর