আমাকে তাবলিগে পাঠিয়েছিলেন ছদর সাহেব হুজুর

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৬৫ সালের কথা। খুলনার আজম খান সরকারি কলেজে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাধারণত এসব অনুষ্ঠানে বিখ্যাত শিল্পীদের দিয়ে কনসার্টের আয়োজন করা হয়। তবে কলেজের তৎকালীন ছাত্র সংসদের ভিপি চিন্তা করলেন, প্রতিবারের চেয়ে এবারের বার্ষিক উৎসবটা ভিন্ন আয়োজনে করার। তার মাথায় এলো আন্তর্জাতিকমানের সিরাত সম্মেলন করার আইডিয়া। তৎকালীন অল পাকিস্তানের সেরা আলেমদের দাওয়াত করে তিন দিনব্যাপী সিরাত সম্মেলন হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু বাদসাধলেন কলেজের অধ্যক্ষ।

তার ধারণা ছিল খুলনার মতো এলাকায় এত বড় আয়োজন সম্ভব হবে কিনা? এ ভয়ে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু কলেজের ভিপি অধ্যক্ষকে আশ্বস্ত করলেন, সুন্দরভাবেই তারা এত বড় আয়োজনটি করতে পারবে। অনুমতি মেলার সঙ্গে সঙ্গেই ভিপি চলে এলেন ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসায়। ছদর সাহেবখ্যাত শামসুল হক ফরিদপুরীর কাছে এসে জানালেন পরিকল্পনার কথা। আন্তর্জাতিকমানের ১০ জন আলেমের তালিকাও চাইলেন ছদর সাহেবের কাছে।

ছদর সাহেব মুচকি হেসে টেনে নিলেন বুকে। প্রাণভরে দোয়া দিলেন। তরুণ বয়সে এত দুঃসাহসী কাজ করার হিম্মত যার আছে, তাকে তো বুকেই টেনে নিতে হয়। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ আপনাদের যে ভিপির গল্প শুনিয়েছি, তিনি অপরিচিত কেউ নন। বর্তমান ধর্মপ্রতিমন্ত্রী আলহাজ শেখ আবদুল্লাহই ছিলেন খুলনা আজম খান কলেজের তৎকালীন ভিপি। শীতের শেষের এক সন্ধ্যায় তার বাসায় আমাদের এভাবেই জীবনের গল্পগুলো শুনিয়েছেন তিনি। তিনি শোনালেন তার মধুময় অতীতের কথা। শেখ আবদুল্লাহ ছোটবেলা থেকেই পেয়েছেন হজরত শামসুল হক ফরিদপুরীর সান্নিধ্য। গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসাতেই শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল তার। মক্তবের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে হিফজখানায়ও ভর্তি হয়েছিলেন। কয়েক পারা হিফজ করার পর চোখে সমস্যা হলে ছদর সাহেব হুজুরের পরামর্শেই তিনি স্কুলে চলে যান।

জীবনের শুরু থেকে ছদর সাহেবের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, হুজুরের মৃত্যু পর্যন্ত তার পরামর্শেই চলেছেন। কলেজের বার্ষিক উৎসবকে সিরাত সম্মেলনে রূপান্তরিত করার সাহস ছদর সাহেবের সংস্পর্শেই তাকে জুগিয়েছে। উৎসাহী হয়ে জানতে চাইলাম, তারপর সিরাত সম্মেলনের কী হল?

তিনি জানালেন, ছদর সাহেব হুজুর বড় বড় আলেমদের নাম দিলেও নিজে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু হুজুুরের প্রিয় আবদুল্লাহর মধুর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত ছদর সাহেবও গিয়েছিলেন খুলনা আজম খান কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে আয়োজিত সিরাত সম্মেলনে। হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর পাশাপাশি দেশসেরা ইসলামী পণ্ডিতরাও বয়ান করেছেন সে মাহফিলে। ১৮ ভাষায় পণ্ডিত ড. শহীদুল্লাহ তিন দিনই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন।

ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর মুখে তার উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলনের কথা শুনতেই ঘণ্টাখানেক সময় পার হয়ে গেল। এ সময় মন্ত্রী মহোদয় বারবার আবেগাপ্লুত হয়েছেন। কিছু সময় পরপরই তার চেহারা হয়েছে অশ্রুসজল। তার মুখে কথাগুলো শুনে আমরাও হয়েছি উদ্দীপ্ত।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার আগে থেকেই শেখ আবদুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধর্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কাওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নের সফল রূপকারও তিনি। বহুধাবিভক্ত কওমি আলেমদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে তিনি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টাতেই আলেমদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের দূরত্ব কমেছে।

তাবলিগের চলমান সংকটেও তিনি রেখে চলেছেন কাণ্ডারীর ভূমিকা। তাবলিগ জামাতের বিবদমান দু’পক্ষের দূরত্ব কমিয়ে আনতে তিনি পরিশ্রম করছেন রাত-দিন। তাবলিগের দু’পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের গর্ব বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল, ইজতেমা হলেও দু’পক্ষই আলাদাভাবে করার ব্যাপারে ছিল অনড়; কিন্তু হঠাৎ করেই ঘুরে গেল পরিস্থিতি।

একসঙ্গে ইজতেমা করার ব্যাপারে দু’পক্ষই একমত হল, শুধু তাই নয় এতদিন যাদের একসঙ্গে বসানোও যায়নি, তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের তাবলিগপ্রেমীদের মাঝে ছড়িয়ে গেল আনন্দের বন্যা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করেছেন। তাবলিগের দু’পক্ষই এখন মারমুখো মনোভাব ছেড়ে সমাধানের চিন্তা করছেন।

২০১৯ সালের বিশ্ব ইজতেমাও সুন্দরভাবে আয়োজনে একমত হয়েছেন সবাই। ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ইজতেমার সংকট নিরসনে তিনি কীভাবে কাজ করছেন। এক কথায় তিনি জানালেন, সুন্দরভাবে ইজতেমা করতে যদি কারও পায়ে ধরা লাগে, আমি সেটিও করতে রাজি আছি। তার কাছে জানতে চাইলাম, কীভাবে দু’পক্ষকে অনড় অবস্থান থেকে সরালেন।

তিনি বললেন, ‘তাবলিগের যে দুটি পক্ষ হয়েছে, দুই পক্ষই তাবলিগের প্রতি আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আমরা যখন একসঙ্গে ইজতেমা করার কথা বলেছি উভয়পক্ষই নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে ইজতেমা করার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আমরা একটি নজির স্থাপন করেছি। কারণ বিবাদ সত্ত্বেও তাবলিগের দু’পক্ষই একসঙ্গে ইজতেমা করবেন। মূলত আমাদের সবার দিলের চাওয়া যখন এক হয়েছে, তখন আল্লাহ সবার মন নরম করে দিয়েছেন। আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া এটি অসম্ভব ছিল।

ইজতেমার নিরাপত্তাসহ চ্যালেঞ্জের যে বিষয়গুলো রয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আসলে আল্লাহর রহমতই আমাদের ভরসা। দু’পক্ষের মুরব্বিরাই যথেষ্ট আন্তরিক। যেহেতু আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য সবাই তাবলিগ করে, তাই বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে কিছুটা ছাড় উভয়পক্ষকে দিতে হবে। তবে আমরা এতটুকু অবশ্যই বলব, প্রতি বছরের মতোই সুন্দরভাবে এবারের ইজতেমাও সফলভাবে সম্পন্ন হবে ইনশাআল্লাহ। এজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়াও কামনা করেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী।

বিশ্ব ইজতেমা বা তাবলিগে যাওয়ার কোনো স্মৃতি আছে কিনা জানতে চাইলে ছদর সাহেব হুজুরের স্নেহধন্য প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ বলেন, ‘তাবলিগ জামাতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শৈশব থেকেই। হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) আমাকে প্রথম ইজতেমায় পাঠিয়েছিলেন। একদিনের নিয়ত করে গেলেও আমি তিন দিনই ছিলাম। কারণ ইজতেমা ময়দানে যাওয়ার পর অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছিল।’

ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর কাছে হজসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা প্রশ্ন ছিল, সব প্রশ্নের উত্তর তিনি এক কথায় দিয়েছেন। বললেন সময় দেন, মাত্র তো শুরু। ইনশাআল্লাহ, আগামীতে পরিবর্তন দেখবেন।

কাওমি স্বীকৃতিসহ নানামুখী সফলতার জন্য শেখ আবদুল্লাহ ধর্মীয় অঙ্গনে আগে থেকেই জনপ্রিয়, বিশ্ব ইজতেমার জটিলতা দূর করে সফলতার বহরে আরেকটি পালক পরলেন তিনি।

সূত্র- যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর