মক্কা শরিফের জুমার খুতবা সত্যের কাছে ফিরে আসুন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বড় মনের লোকেরা দ্রুত সত্যে সাড়া দিতে নাক সিঁটকায় না। ভুলের ওপর বেঁকে বসে সন্তুষ্ট হয় না। তার মর্যাদাগত অবস্থান তাকে আল্লাহর আদেশের সামনে বিগলিত হতে অন্তরায় হতে পারে না। বোখারি ও মুসলিমের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি কোনো কসম করে যদি তার বিপরীতে কল্যাণ দেখি ইনশাআল্লাহ, অবশ্যই আমি আমার কসমের কাফফারা দিই এবং ভালো কাজটি করি।’

আদম সন্তানের প্রকৃতি ও দুর্বলতার অন্যতম প্রমাণ তার অবস্থার বদল, পরিবর্তন ও রূপান্তর। সে পতিত হয় দ্বন্দ্ব ও দ্বিধায়, বৈপরিত্য, সংশয় ও অস্থিরতায়। এক সময় সে একটি কথা রচনা করে আবার ভবিষ্যতে তা প্রত্যাহার করে নেয়। আজ একটি সিদ্ধান্ত নেয়, আগামীকাল তা স্থগিত করে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানবের মানসিক, চৈন্তিক ও দৈহিক গঠনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেÑ ‘মানুষ সৃজিত হয়েছে দুর্বল হিসেবে।’ (সূরা নিসা : ২৮)। তাই তো সে সবদিক থেকে দুর্বল : গঠনে দুর্বল, ইচ্ছায় দুর্বল, সংকল্পে দুর্বল, চিন্তায় দুর্বল, জ্ঞানে দুর্বল ও সহিষ্ণুতায় দুর্বল।

এত কিছু সত্ত্বেও যা মোমিনকে বৈশিষ্ট্যম-িত করে এবং তার জ্ঞানের ভারসাম্য ও রবের আনুগত্যের প্রমাণ দেয়, তা হলো ন্যায্যতার কাছে তার ফিরে আসা এবং যাতে নিজের ভুল ও দোষ ধরা পড়ে তা পরিত্যাগ করা। তাই তো সে কুণ্ঠিত হয় না নিজের কথা, কাজ বা মত থেকে ফিরে আসতে। যখন সে নিজের বিপরীতে সত্যকে দেখতে পায়, নিজের অবস্থানে সে অনঢ় থাকে না। সে পরোয়া করে না কে তাকে পল্টিবাজ বা মত বদলকারী বলল। কেননা, সত্যের কাছে ফিরে আসা সম্মানের এবং এটিই প্রকৃত হৃদয়বানের মর্যাদা। এমন নয় যেমন শয়তান কিছু লোকের সামনে সুশোভিত করে সম্মান মতো বা ভুলের ওপর অটল থাকায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যাদের মনে তাকওয়া রয়েছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে।’ (সূরা আরাফ : ২০১)। ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘অর্থাৎ, আল্লাহর শাস্তি ও অফুরান প্রতিদান এবং তাঁর ওয়াদা ও হুঁশিয়ারির কথা স্মরণ করে। অতপর দ্রুতই তাওবা করে, ফিরে আসে এবং আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন ও আশ্রয় প্রার্থনা করে।’

এটি আমাদের জন্য এই কাজ ওই কাজ পুনর্বিবেচনার সুযোগ। সুতরাং ব্যক্তির যতই পদস্খলন ঘটুক সে অবিলম্বে ফিরে আসবে এবং দ্রুত তাওবা করবে। সে তো সত্যেরই সন্ধানী ও সত্যই প্রত্যাশী। সে তো নিজ রবের আদেশ ও তাঁর সন্তুষ্টি বাস্তবায়নেই সচেষ্ট। যে এ কাজ করবে সে উত্তম বিশেষণে অন্তর্ভুক্ত হবে। যার কথা বলেছেন শ্রেষ্ঠতম মানব (সা.)। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক আদম-সন্তানই পাপী। আর পাপীদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তওবা করে।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।

ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে ব্যক্তি কীভাবে নিজেকে শ্রেয়র কাছে প্রত্যাবর্তনে অভ্যস্ত করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনে-শুনে তাই করতে থাকে না।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৫)। অর্থাৎ, তারা নিজেদের কৃত গোনাহে অনড় থাকে না। বরং তওবা-ইস্তেগফার করে এবং হেদায়েতের পথে ফিরে আসে। তারা তাদের মতো করে না যাদের ব্যাপারে নবী (সা.) নিজ বাণীতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা কোনো কথা না শোনার জন্য নিজেদের বন্ধ করে নিয়েছে তাদের জন্য ধ্বংস, যারা অন্যায় করার পর জেনে-বুঝে বারবার করে তাদের জন্যও ধ্বংস।’ (মুসনাদ আহমাদ)।

যে একদিক দিয়ে সত্য শ্রবণ করে আর অন্য দিক থেকে তা বের করে দেয়, সে এ হাদিসের অন্তর্ভুক্ত। ভেতরে সত্যকে স্থির হতে দেয় না। নবী (সা.) ধ্বংসের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাদের জন্য, যারা সত্য শ্রবণ করে শ্রেয়তরকে অনুসরণ করে না। যারা সত্যকে সত্য হিসেবে জানার পরও তার সহযোগিতা করে না; তদনুযায়ী কাজ করে না; বরং নিজেরা যার ওপর আছে তাকে বিশুদ্ধ জ্ঞান করে কিংবা বাড়াবাড়ি বা অন্ধ অনুসরণ অথবা অহংকারবশত উদাসীনতা দেখায়।

বড় মনের লোকেরা দ্রুত সত্যে সাড়া দিতে নাক সিঁটকায় না। ভুলের ওপর বেঁকে বসে সন্তুষ্ট হয় না। তার মর্যাদাগত অবস্থান তাকে আল্লাহর আদেশের সামনে বিগলিত হতে অন্তরায় হতে পারে না। বোখারি ও মুসলিমের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি কোনো কসম করে যদি তার বিপরীতে কল্যাণ দেখি ইনশাআল্লাহ, অবশ্যই আমি আমার কসমের কাফফারা দিই এবং ভালো কাজটি করি।’

এ থেকে বোঝা গেল, মুসলিমের জন্য তার সংকল্প প্রত্যাহার করে নেওয়াই শ্রেয় যখন তিনি কল্যাণ দেখতে পান নিজ প্রতিজ্ঞার বিপরীতে। অতএব, কোনো কাজ করা বা না করা বিষয়ে যতই শপথ করুন না কেন, যখন পরিষ্কার দেখা যাবে যে ওই শপথ না রক্ষা করাই কল্যাণ, তার করণীয় হবে শপথের কাফফারা দেওয়া এবং কল্যাণকর কাজটিই সম্পাদন করা। এটিই করেছিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। কন্যা আয়েশা (রা.) এর অপবাদের রটনায় যখন মিসতাহও (রা.) জড়িয়ে গেলেন, আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! মিসতাহ যখন আয়েশার ব্যাপারে অপবাদ রটিয়েছে; এরপর আমি আর তার জন্য কখনও কিছু খরচ করব না।’ তখন আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা উচ্চমর্যাদা ও আর্থিক প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন কসম না খায় যে, তারা আত্মীয়-স্বজনকে, অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের কিছুই দেবে না। তাদের ক্ষমা করা উচিত এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করা। তোমরা কি কামনা কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।’ (সূরা নুর : ২২)।

তখন আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ তায়ালা আমাকে ক্ষমা করে দিন এটা আমি নিশ্চয়ই পছন্দ করি।’ তিনি কাফফারা দিলেন এবং পুনরায় মিসতাহের ভরণ-পোষণের ওই খরচ দেওয়া শুরু করলেন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তার খরচ দেওয়া আর কখনও বন্ধ করব না।’ তেমনি আবুদ্দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় আবু বকর (রা.) পরনের কাপড়ের একপাশ এমনভাবে ধরে এলেন যে, তার দুই হাঁটু বেরিয়ে পড়ছিল। নবী (সা.) বললেন, ‘তোমাদের এ সাথী এইমাত্র কারও সঙ্গে ঝগড়া করে আসছে।’ তিনি সালাম করলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার এবং ওমর ইবনুল খাত্তাবের মাঝে একটি বিষয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে।

আমিই প্রথমে কটু কথা বলেছি। অতঃপর লজ্জিত হয়ে তার কাছে মাফ চেয়েছি। কিন্তু তিনি আমাকে মাফ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখন আমি আপনার কাছে হাজির হয়েছি।’ নবী (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন হে আবু বকর! আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন হে আবু বকর! আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন হে আবু বকর! এরই মধ্যে ওমর (রা.) লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আবু বকর (রা.) এর বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আবু বকর কি বাড়িতে আছেন? তারা বলল, না। তখন ওমর (রা.) নবী (সা.) এর কাছে চলে এসে সালাম দিলেন। (তাকে দেখে) নবী (সা.) এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল।

আবু বকর (রা.) ভীত হয়ে নতজানু হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমিই প্রথমে অন্যায় করেছি। হে আল্লাহর রাসুল! আমিই প্রথমে অন্যায় করেছি। তখন নবী (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ যখন আমাকে তোমাদের কাছে রাসুলরূপে প্রেরণ করেছেন তখন তোমরা সবাই বলেছ, আপনি মিথ্যা বলছেন আর আবু বকর বলেছে, আপনি সত্য বলেছেন। তাঁর জান-মাল সবকিছু দিয়ে আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছে। তোমরা কি আমার সম্মানে আমার সাথীকে অব্যাহতি দেবে? তোমরা কি আমার সম্মানে আমার সাথীকে অব্যাহতি দেবে?’ এরপর আবু বকর (রা.) কে আর কখনও কষ্ট দেওয়া হয়নি। (বর্ণনায় বোখারি)।

দেখুন, সাহাবায়ে কেরামেরও ভুল হতো। তাঁরা নিষ্পাপ ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা দ্রুতই সত্যের কাছে ফিরে আসতেন। এটিই ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা তাঁদের মহান বৈশিষ্ট্যম-িত করেছিল। আমাদের উচিত তাঁদেরই অনুসরণ করা। ভুলের ওপর হঠকারিতা না দেখিয়ে দ্রুত সত্যের কাছে ফিরে আসা।

১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর