যেভাবে বদলে গেল সালমার জীবন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ স্বামী, দুই কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার সালমা বেগমের। পাকুন্দিয়া উপজেলার আংগিয়াদী গ্রামের এই নারীর সহায় সম্বল বলতে ছিল বসতভিটার শতাংশ জমি। স্বামী-স্ত্রীর কায়িক শ্রমই ছিল পরিবারের রোজগারের একমাত্র উপায়। অভাবের সংসারে সন্তানের পড়াশোনা আর তিন বেলা দু’মুঠো ভাত যোগাড় করা ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। একটি দিন পার হলে সালমাকে ভাবতে হতো, আগামী দিনটি কীভাবে যাবে? পরিবারের সদস্যদের খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটাতে হতো। স্বামী আতাবুর মাটি কাটার কাজ করতেন। যেই দিন মাটি কাটতে পারেন, সেই দিনটি মোটামুটি চলে যেতো। আর যেই দিন মাটি কাটতে পারতেন না, সেই দিনটি চলতো খুবই কষ্টে।

এ রকম দুঃসহ অবস্থায় বাড়ির পাশে ১৫ শতাংশ জমি চুক্তিতে নিয়ে সবজি চাষ করতে শুরু করেন সালমা। সবজি চাষ করতে গিয়েও অর্থের অভাবে সময়মত সার কীটনাশক দিতে না পারায় ফলন ভাল পেতেন না। উল্টো ধার দেনা করতে হতো তাকে। গ্রামের এনজিওগুলো থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েও দিশেহারা ছিলেন সালমা। এনজিওর কিস্তি ঠিকমত চালাতে পারতেন না তিনি। চিন্তা ভাবনার শেষ নেই যেন তার। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ শতাংশ জমিতে টমেটো বাগানে মড়ক দেখা দেয়। মড়ক রোগের সমস্যা সমাধানে সালমা ছুটে যান স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হামিমুল হক সোহাগের কাছে।
তিনি মড়ক রোগের সমস্যার সমাধান দেন এবং পরামর্শ দেন সিআইজি সদস্য হওয়ার। সে অনুযায়ী সালমা সিআইজি সদস্য হয়ে যান। কিছুদিন পর সিআইজি সদস্য হিসাবে সালমা ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ-২ প্রজেক্ট (এনএটিপি-২) থেকে একটি মার্স স্কেল ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন প্রদর্শনী পান। প্রদর্শনীর উপকরণ হিসেবে ৬টি রিং ও ৬টি স্লাব, ৬টি টিন এবং ৬ পাতিল কেঁচো পান। শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন। প্রথম অবস্থায় উৎপাদিত সার নিজের জমিতে ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত সার বিক্রি করে টাকা উপার্জনে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াতে থাকেন সালমা। জায়গার অভাবে নিজের বসত ঘরে ছোট করে ৩০টি রিং দিয়ে গড়ে তুলেন সালমা ভার্মি প্ল্যান্ট-১। এরপর আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি সালমাকে।
শুরু হয় সালমার সার আর কেঁচো বিক্রির নতুন জীবন। মানুষের বাড়িতে সার বা কেঁচো পৌছে দিতে কিনেন বাই সাইকেল। বনে যায় দুরন্ত সালমা। গ্রাম থেকে গ্রামে সাইকেলে চড়ে কেঁচো সারের খবর পৌঁছে দেন এবং বিক্রি করেন নিজের উৎপাদিত কেঁচো এবং সার। উপজেলা কৃষি বিভাগ তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করে। কৃষি মেলায় ভার্মি কম্পোস্ট সারের স্টল দিয়ে বিক্রি করেন সার। তার সারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলায়। তার উৎপাদিত সার এবং কেঁচো এখন মানুষজন তার বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যায়।
সালমার এই দিনবদল সম্পর্কে স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হামিমুল হক সোহাগ বলেন, সমপ্রতি কুমিল্লা বোর্ডের একটি প্রকল্পে শুধু কেঁচো বিক্রি করে ৩৮ হাজার টাকা পান সালমা। সেই টাকা পেয়ে জায়গা ভাড়া করে ৫০টি রিং দিয়ে তিনি সালমা ভার্মি প্ল্যান্ট-২ স্থাপন করেন। যেখানে এখন শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে হয় তাকে। সালমার একটি বড় গুণ হচ্ছে, তাকে যেভাবে পরামর্শ দেওয়া হয় তিনি ঠিক সেই ভাবে বাস্তবায়ন করেন। সকল উপকরণ সঠিকভাবে দিয়ে তিনি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করেন। তাই তার সারের গুণগত মান সঠিক থাকে এবং কৃষক ব্যবহার করে ভাল ফলন পায়। এ কারণে সালমার সারের আলাদা সুনাম রয়েছে এলাকাতে। তার সার অবিক্রিত থাকে না।
হামিমুল হক সোহাগ যোগ করেন, ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন এখন সিআইজি ও নন সিআইজি কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে খামা গ্রামকে ভার্মি কম্পোস্ট গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত সার ও কেচোঁ কিশোরগঞ্জ জেলা ছাড়াও অনান্য জেলায়  যাচ্ছে। যার ফলে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় আঙ্গিয়াদী ব্লকের সিআইজি সদস্য সালমা বেগমের সাথে। সার উৎপাদন সর্ম্পকে জানতে চাইলে সালমা বেগম জানান, তিনি একজন প্রান্তিক চাষী। তার স্বামী অথবা তিনি নিজে জমি চুক্তি নিয়ে সবজি চাষ করেন। সবজি চাষাবাদ করার জন্য সার, কীটনাশক ক্রয় ও তিন সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে তাকে দারিদ্রতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হতো। দেড় বছর আগে তিনি ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ-২ প্রজেক্ট (এনএটিপি-২) এর আওতায় খামা বিলপাড় সিআইজি থেকে একটি মার্স স্কেল ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন প্রদর্শনী পান।
সেখান থেকে তার ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু। এই ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন প্রদর্শনী ছিল তার জন্য আর্শিবাদস্বরূপ। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হামিমুল হক সোহাগ পাশে থেকে তাকে সার্বিক পরামর্শ প্রদান করেছেন। সবজি চাষে আগ্রহী করে তুলছেন এবং সবজি চাষে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করা শিখিয়েছেন। তার পরামর্শে সালমার স্বামী ফুল চাষ, বসত বাড়ীতে সবজি বাগান, ড্রাগন ফল, ভিয়েতনামী নারিকেল ও ভাসমান বীজতলা প্রভৃতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যার ফলে এখন আর তাদের সংসার চালাতে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। কোন বেলা না খেয়ে থাকতে হয় না।
সার ও কেঁচো বিক্রি করে তাদের সংসারের খরচ বাদে আয়ও হয় কিছু টাকা। সালমা বেগম বলেন, কেঁচো সার যে মানুষের জীবন বদলাতে পারে তার বাস্তব উদাহারণ আমি নিজেই। আর আমার কেঁচো বা সার কোনটাই অবিক্রিত থাকে না। এর কারণ হলো কোন ব্যক্তি এ সার উৎপাদন করতে চাইলে আমি নিজে সাইকেল চালিয়ে তার বাড়িতে গিয়ে স্থাপন করে দিয়ে আসি। এতে আমার যাতায়াত খরচ বেঁচে যায়। এছাড়া আসা-যাওয়ার সময় অন্যান্য কৃষকের সাথে দেখা হলে তাদেরকেও এ সার উৎপাদন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে পরামর্শ দেই। একজন নারী হিসেবে আমার এ সফলতা দেখে এলাকার অনেক নারী এখন এগিয়ে আসছেন। এ সার উৎপাদনের কাজে তারা এখন সম্পৃক্ত হচ্ছেন।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর